মন্দ ঋণে নাজুক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক
>> মন্দ ঋণ বেশি জনতা ব্যাংকের
>> খারাপ অবস্থায় বেসিক ব্যাংক
>> নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যর্থ চার ব্যাংক
হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, ক্রিসেন্ট গ্রুপসহ বিভিন্ন বড় বড় ঋণ জালিয়াতি এবং অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দুরবস্থায় পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক। জনতা, রূপালী, সোনালী, অগ্রণী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডে নিয়মিত বাড়ছে মন্দ ঋণের পরিমাণ। ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ৪০ থেকে ৪৭ শতাংশই মন্দ হয়ে গেছে। এতে সরকারি এই ছয় ব্যাংকের মধ্যে চারটিই নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক মোট ১ লাখ ৭০ হাজার ১৭৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি (শ্রেণিকৃত) ঋণের পরিমাণ ৫৩ হাজার ৭৪৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দ বা কুঋণের পরিমাণ ৪৯ হাজার ৫০৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা; যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৯.০৯ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের। এ ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০ হাজার ৯৯৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণ ১৮ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ রয়েছে সোনালী ব্যাংকের। এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১২ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, যার প্রায় ২৭ শতাংশ বা ১১ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা মন্দ ঋণ। ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকটি। জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১ হাজার ৯৪২ কোটি ২০ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মন্দ ও খেলাপি ঋণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসিক ব্যাংক সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৬০ দশমিক ৫০ শতাংশ খেলাপি। এর মধ্যে ৫৭ দশমিক ৭৩ শতাংশই মন্দ বা কুঋণ। চলতি বছরের জুন শেষে বেসিক ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৯ হাজার ১১৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা; যার ৮ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা মন্দ ঋণ। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতিও সবচেয়ে বেশি; যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল আলম বলেন, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালে ব্যাংকের বেশকিছু বড় অনিয়ম হয়। আমরা অনিয়ম ও এর সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের নিহ্নিত করেছি। এখন ওসব ঋণ আদায়ের চেষ্ট চলছে। অনেক ঋণ আদায় হয়েছে। আশা করছি, আগামীতে সমস্যা কেটে যাবে।
এদিকে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বেসিক ব্যাংক পরিদর্শন করেন। এ সময় ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, বেশি বেতন নেবেন, কাজ করবেন না, এটা হবে না। বেসিক ব্যাংক ভালো ব্যাংক ছিল। রাতারাতি তলানিতে পৌঁছেছে। একটা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান এভাবে চলতে পারে না। এখন আপনাদের সামনে দুটি অপশন আছে। চালু রাখা অথবা বন্ধ করা। সরকার ও দেশের জনগণ যেখানে মালিক, সেখানে কোনো প্রতিষ্ঠান বসে যাক, সেটা কেউ চাইবে না।
অর্থমন্ত্রী বলেন, যারা টাকা নিয়ে গেছে, তাদের চিনি না, এটা হতে পারে না। যাদের ঠিকানা আছে, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমাকে দেবেন। এরপর তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায়, দেখব। কেউ অন্যায় করে যদি স্বীকার করে, তাহলে তাদের মাফ করে দেয়া হবে। তবে টাকা নিয়ে যারা ফুর্তি করেছে, তাদের কোনো মাফ নেই।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) অবস্থাও নাজুক। প্রতিষ্ঠানটির ১ হাজার ৫৯১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বিতরণ করা ঋণের ৫৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ বা ৮৯০ কোটি টাকা খেলাপি। এর মধ্যে ৫৩ শতাংশ বা ৮৫১ কোটি ২৪ লাখ টাকা কুঋণ।
চলতি বছরের জুন শেষে রূপালী ব্যাংক ২৪ হাজার ৯৮৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৪ হাজার ৩১১ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ২৫ শতাংশ, যার ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ বা ৪ হাজার ১৯১ কোটি টাকা মন্দ বা কুঋণ। রূপালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৯৮২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
আলোচিত সময়ে অগ্রণী ব্যাংক ৩৮ হাজার ৩৭০ কোটি ৯৮ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৬ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা বা ১৬ দশমকি ৩৪ শতাংশ। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ বা ৫ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা কুঋণ। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৮৫২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারি ব্যাংকে যারা ঋণখেলাপি, তাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে এবং তারা যথেষ্ট প্রভাবশালী। কাজেই ইচ্ছা করলেই ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে সহজে ব্যবস্থা নিতে পারে না। অডিট কমিটির স্বাধীনভাবে কাজ করার কথা থাকলেও তারা তা করতে পারছে না। এ ছাড়া খেলাপি হয়েও কোনো সমস্যা হচ্ছে না, উল্টো বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। এসব কারণে সরকারি ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হচ্ছে।
খেলাপি কমাতে কী করা উচিত- জানতে চাইলে বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, কীভাবে খেলাপি ঋণ কমাতে হয়, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভালো জানে। কিন্তু যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারে না। ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এ ছাড়া তাদের সুযোগ-সুবিধাও বন্ধ হয়নি। উল্টো সবিধা নিয়ে আবারও খেলাপি হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ব্যাংক আরও সমস্যায় পড়বে।
‘তাই ব্যাংক খাতে চলমান এ সমস্যা থেকে উত্তোরণের একমাত্র পথ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, এ খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, ব্যাংক কোম্পানি আইনের যে দুর্বলতা রয়েছে, তা দূর করা, একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া। এর কোনো বিকল্প নেই’,- বলছিলেন প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় পর্যবেক্ষণের পরও সরকারি চার ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতিতে নাজুক অবস্থায় ব্যাংকগুলো। শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় নিয়ে সন্তোষজনক নয়। এমন পরিস্থিতিতে যেসব ব্যাংকের মন্দ ঋণ বা খেলাপি বেড়েছে তার কারণ জানাতে চেয়ে চিঠি দেয়া হবে। একই সঙ্গে আগামী তিন মাসে কীভাবে মন্দ ঋণ কমানো যায়, সে বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে নির্দেশ দেয়া হবে।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়।
খেলাপি ঋণ বাড়লে, আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়। তাই খেলপি বাড়ছে। আর প্রভিশন রাখতে গিয়ে ঋণের বিরতণের সক্ষমতা কমে যায়, যার প্রভাব পরে ব্যাংকের মুনাফায়।
সম্প্রতি সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী এক বছরের বেশি অনাদায়ী ঋণ মন্দ ঋণ হয়। আগে ৯ মাসের বেশি অনাদায়ী ঋণ মন্দ ঋণ হিসেবে বিবেচিত হতো।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে শেয়ারহোল্ডাদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
এসআই/জেডএ/জেআইএম