এখনও চামড়ার উৎকট গন্ধ পোস্তায়
রাজধানীর লালবাগের শায়েস্তা খান রোডের সাবেক র্যাব কার্যালয়ের পাশে রিকশা থামিয়ে চালক বললেন, ‘ওই যে মিনারটা দেখা যাচ্ছে। ওটাই পোস্তার শাহী মসজিদ। ওইখানেই সব চামড়ার আড়ত।’
রাস্তা ফাঁকা ছিল, ব্যাটারিচালিত এ যানটি মাত্র ১ মিনিট এগোলেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া যেত। তারপরও তিনি সেখানে না গিয়ে নামিয়ে দিলেন। ক্রমেই পোস্তার মসজিদের দিকে যত এগোচ্ছিলাম, ততই রিকশাচালকের না আসার কারণটা উপলব্ধি করতে পারছিলাম।
মসজিদে যাওয়ার আগে একটা ডাস্টবিন চোখে পড়ল। সেটার কাছাকাছি যেতেই এতটাই উৎকট গন্ধ আসছিল যে, দম নেয়াই দায় হয়ে পড়েছিল। ভাবলাম, ডাস্টবিনটা অতিক্রম করলেই বোধহয় এ দুর্গন্ধ থেকে রেহাই মিলবে। কিন্তু ঘটল ঠিক উল্টো। এরপরই দেখা মিলল, রাস্তার দুই পাশে কাঁচা চামড়ার আড়ত। সেখানে দুর্গন্ধ এতটাই উৎকট ছিল যে, আর দম নিতে পারছিলাম না। বমি আসতে লাগল।
দ্রুত ছুটলাম সামনের দিকে, চামড়ার আড়ত নেই-এমন জায়গার খোঁজে। প্রত্যাশিত জায়গা পেলেও গন্ধ থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন তাকিয়ে দেখলাম, অল্প কিছু মানুষ মাঝে মধ্যে নাক-মুখ কাপড় দিয়ে চেপে ধরছেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই স্বাভাবিকভাবে সেখানে চলাফেরা করছেন। তাদের স্বাভাবিক চলাফেরা দেখে অবাক হলাম।
আবার বমি আসছিল। বুঝতে পারলাম, এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা সম্ভব না। নাক-মুখ শার্ট দিয়ে চেপে দম বন্ধ করে দ্রুত গতিতে হাঁটা শুরু করলাম। যেখানে রিকশা থেকে নেমেছিলাম, আবার সেখানে এসে মুখ থেকে কাপড় সরালাম।
অল্প একটু দম নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক রিকশাচালককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমি তো টিকতে পারলাম না, আপনারা কাঁচা চামড়ার আড়তের সামনে দিয়ে কীভাবে চলাফেরা করেন?’
মো. মনির হোসেন নামে ওই রিকশাচালক বলেন, ‘আমরাও টিকতে পারি না। ওই দিকে এখন আর যাই না। এই যে দেখছেন, এ মোড় থেকেই চলে যাব। তারপরও ঠেকায় পড়ে যাওয়া-আওয়া করন লাগলে মুখে গামছা বেঁধে যাই। যারা ওখানে দীর্ঘদিন ধরে থাকে, তাদের অনেকটাই সয়ে গেছে। তাদের তো সেখানে না থেকেও উপায় নেই।’
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা মনির হোসেন লালবাগ এলাকায় ১৬ থেকে ১৭ বছর ধরে রিকশা চালান। তার বক্তব্য, ‘এ গন্ধে অনেকের রোগবালাই হয়ে যায়। বুঝতেছেন না, এখান থেকে গন্ধ আসতেছে। এ ট্যানারি এখানে রাখাই ঠিক না। কিন্তু সরকার সরাইতে পারে না তাদের।’
সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতেই দেখা মেলে চামড়ার আড়তদার মো. আফতারের। রিকশা খুঁজতে খুঁজতে তিনি শাহী মসজিদ থেকে কিছুটা এগিয়ে এসেছেন। পুরান ঢাকার এ পোস্তায় ৪০ বছর ধরে চামড়ার আড়তদারি করছেন তিনি।
দুর্গন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে আফতাব জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোরবানির সময় এবার লবণের দাম ৭০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫০০ থেকে ১৭০০ টাকা হয়ে গেছিল। তাই অনেক আড়তদারই তাদের চামড়ায় কম লবণ দিয়েছে। অন্যবার ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনলেও এবার সে তুলনায় চামড়া কম কিনেছে। সে জন্যও আড়তে চামড়ার বাড়তি চাপ। লবণের বেশি প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজনীয় লবণ আড়তদাররা ছিটায় নাই। লবণের অভাবে এবার গন্ধও একটু বেশি।’
এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘৮ ঘণ্টার মধ্যে চামড়া সংরক্ষণ করতে হলেও অনেকে সেই কাজ করতে পারে নাই। ঈদের দিন সকাল ৮টার চামড়া ঈদের পরদিন ৮টায়ও আমাদের কাছে এসেছে। যথাসময়ে চামড়া সংরক্ষণ না করায় চামড়ার গন্ধ এবার বেড়েছে।’
‘আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। তারপরও গন্ধ লাগে,’ যোগ করেন এবার ১৫০০ পিস চামড়া কেনা এ আড়তদার।
রাস্তায় গরুর লেজ পড়ে থাকতে এবং চামড়া সংরক্ষণাগার থেকে চামড়ার তরল বর্জ্য রাস্তায় এসে পড়তেও দেখা যায় পোস্তায়।
আড়তদারদের দৃষ্টিতে এবার যে কারণে চামড়ার দামে ধস
এবার চামড়ার দাম ধসে আড়তদাররা দোষারোপ করছেন ট্যানারি মালিকদের। আর ট্যানারি মালিকরা দোষারোপ করছেন আড়তদার, মৌসুমী ব্যবসায়ী এবং কোরবানি দাতাদের। তবে তারা সবাই স্বীকার করছেন, এবার চামড়া নষ্ট হওয়ার কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে চামড়া শিল্প।
আড়তদাররা বলছেন, তাদের সংরক্ষিত কাঁচা চামড়া এখন পর্যন্ত কিনছেন না ট্যানারি মালিকরা। তবে আজ রোববার (১৮ আগস্ট) থেকে আড়তদারদের কাছ থেকে চামড়া কেনার কথা থাকলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের বৈঠক ছিল। এ বৈঠক থেকে সমাধান আসলে সোমবার থেকে সংরক্ষিত চামড়া ট্যানারির মালিকদের কাছে বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা আড়তদারদের।
আড়তদার মো. আফতাব জাগো নিউজের কাছে অভিযোগ করেন, ‘ট্যানারি মালিকদের কাছে কোনো কোনো আড়তদার ৫ বছর আগের, কেউ ১২ থেকে ১৫ বছর আগের টাকা পায়। সেই টাকা পরিশোধ করছে না ট্যানারি মালিকরা। তাই এ বছর আমরা চামড়া কিনতে ঢিলেমি করেছি। কারণ আমাদের কাছে টাকা নাই। এ জন্য দায়ী মূলত ট্যানারি মালিকরাই।’
পোস্তায় আসার আগে সকালে রাজধানীর হাজারীবাগের পুরাতন ট্যানারিগুলো ঘুরে দেখা হয়। সেখানে কথা হয় সাভারের হেমায়েতপুরের মদিনা লেদার কমপ্লেক্সের স্বত্বাধিকারী বেলাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘চামড়া বেচাকেনা করে সুখ পাওয়া যায় না। ট্যানারি মালিকরা বিধ্বস্ত ও বিভ্রান্তির মধ্যে আছে।’
বেলাল হোসেনের অভিযোগ, এ বছর চামড়া ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির জন্য আড়তদার, মৌসুমী ব্যবসায়ী ও কোরবানিদাতারা দায়ী। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘আমরা মাঠ পর্যায় থেকে চামড়া কিনি না। কেনে চামড়ার আড়তদার ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। তারা চামড়া ঠিক মতো কেনেনি দেখে এ বছর চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘৮ ঘণ্টা পর চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। এবার অনেক চামড়াই ৮ ঘণ্টা পরে বা সন্ধ্যার পরে বিক্রি করতে নিয়ে এসেছে। তখন ৫০০ টাকার চামড়া ৫০ টাকা দিয়েও কেনা যায় না। কারণ ওই চামড়া আর কোনো কাজে আসে না।’
বৃষ্টিসহ নানা কারণে এবার আবহাওয়া চামড়ার অনুকূলে ছিল না বলেও জানান তিনি।
চামড়া শিল্পকে গণমাধ্যমই ধ্বংস করছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা যেমন পরিবারের কেউ খারাপ কাজ করলে তা প্রকাশ করি না। তার দাবি খারাপ কাজ করলে তা প্রকাশ করা ঠিক না। এটা করে দেশের চামড়া শিল্প ক্ষতির মুখে পড়েছে।’
চামড়া সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়ে বেলাল হোসেন বলেন, ‘যারা কোরবানি দেয় তারা ৫ থেকে ৬ দিন পর্যন্ত চামড়া সংরক্ষণ করলেও চামড়া নষ্ট হবে না এবং চামড়ার মূল মালিকরাই ভালো দাম পাবে।’
পিডি/এনডিএস/জেআইএম