ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

মিউচ্যুয়াল ফান্ডের আচরণ কতটা স্বাভাবিক?

সাঈদ শিপন | প্রকাশিত: ১১:২৭ এএম, ২২ জুলাই ২০১৯

বছরের পর বছর ধরে পুঁজিবাজারে ধুঁকতে থাকা মিউচ্যুয়াল ফান্ড হঠাৎ করে রূপকথার আলাদিনের চেরাগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ফলে একসময় বিনিয়োগকারীদের গলার কাঁটায় পরিণত হওয়া মিউচ্যুয়াল ফান্ড চলমান মন্দাবাজারেও সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। মাসেরও কম সময়ের মধ্যে কিছু মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এমনকি ১৫ দিনের মধ্যে দাম বেড়ে তিনগুণ হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

পুঁজিবাজারে আলাদিনের চেরাগের ভূমিকায় আসা এমন একটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড এসইএমএল এফবিএলএসএল গ্রোথ ফান্ড। মাত্র ১১ কার্যদিবসে ফান্ডটির দাম বেড়ে প্রায় তিনগুণ হয়েছে। হঠাৎ দামে এমন উল্লম্ফন হওয়া এ ফান্ডটির ইউনিটের দাম ১৮ জুলাই লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে ২৭ টাকা ৮০ পয়সা। যা ৩ জুলাই ছিল মাত্র ১০ টাকা। সে হিসাবে ১১ কার্যদিবসে ফান্ডটির দাম বেড়েছে ১৭ টাকা ৮০ পয়সা বা ১৭৮ শতাংশ।

অন্যভাবে বলা যায়, একজন বিনিয়োগকারী জুলাই মাসের শুরুতে ১০ লাখ টাকার এসইএমএল এফবিএলএসএল গ্রোথ ফান্ড কিনলে বর্তমানে তার সেই বিনিয়োগের অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এদিক থেকে বিবেচনা করলে ফান্ডটিতে ১০ লাখ টাকা ১৫ দিন খাটিয়ে ১৭ লাখ ৮০ টাকা মুনাফা পাওয়া গেছে। এ যেন অনেকটা রূপকথার আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতো।

হঠাৎ করে রূপকথার আলাদিনের চেরাগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও গত দুই বছরে এসইএমএল এফবিএলএসএল গ্রোথ ফান্ডের দাম খুব বেশি উঠা-নামা করেনি। ৩ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত গত দুই বছরে ফান্ডটির দাম ১০ থেকে ১২ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে।

মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতের আর এক প্রতিষ্ঠান প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড। গত ২০ জুন ফান্ডটির দাম ছিল ৯ টাকা ৯০ পয়সা। সেখান থেকে টানা বেড়ে ১১ জুলাই ফান্ডটির ইউনিটের দাম ১৯ টাকা ২০ পয়সায় পৌঁছে যায়। অর্থাৎ ২১ দিনের মধ্যে ফান্ডটির দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়।

অন্যভাবে বলা যায়, একজন বিনিয়োগকারী ২০ জুন ১০ লাখ টাকার প্রাইম ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড কিনে ১১ জুলাই মুনাফাসহ তার বিনিয়োগের পরিমাণ ১৯ লাখ ৩৯ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ ১০ লাখ টাকা ২০ দিন খাটিয়ে নয় লাখ ৩৯ হাজার টাকার ওপরে মুনাফা পাওয়া গেছে। অবশ্য এমন ‘অস্বাভাবিক’ দাম বাড়ার পর ফান্ডটির দাম গত কয়েকদিনে কিছুটা কমেছে। ১৮ জুলাই লেনদেন শেষে ফান্ডটির দাম দাঁড়িয়েছে ১৬ টাকা ৫০ পয়সা।

শুধু এসইএমএল এফবিএলএসএল গ্রোথ ফান্ড বা প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড নয় সম্প্রতি বেশির ভাগ মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দামে এমন চাঙাভাব বিরাজ করছে। এরপরও তালিকাভুক্ত ৩৭টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে ২৭টির দাম এখনও অভিহিত মূল্যের (ফেসভ্যালু) নিচে রয়েছে।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) মিউচ্যুয়াল ফান্ডের বোনাস লভ্যাংশ বন্ধ করা বা লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট (আরআইইউ) পদ্ধতি বাতিলের উদ্যোগ নেয়ার সংবাদে হঠাৎ মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দাম বেড়েছে। তবে যে হারে দাম বেড়েছে তা অস্বাভাবিক। আরআইইউ বিষয়টি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে কোনো বিশেষ চক্র দাম বড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।

চলতি মাসের শুরুর দিকে পুঁজিবাজারে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট পদ্ধতি বাতিল করা হচ্ছে। ফলে মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো আর বোনাস লভ্যাংশ দিতে পারবে না। লভ্যাংশ হিসেবে ফান্ডগুলোকে শুধু নগদ লভ্যাংশ দিতে হবে।

বাজারে ছড়িয়ে পড়া ওই গুঞ্জন সত্য প্রমাণিত হয় ১৬ জুলাই। ওইদিন বিএসইসির কমিশন সভার মাধ্যমে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট পদ্ধতি বাতিল করা হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওই সিদ্ধান্তের ফলে বে-মেয়াদি ও মেয়াদি উভয় ধরনের ফান্ড এখন শুধুই নগদ লভ্যাংশ দিতে পারবে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট পদ্ধতি বাতিলের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেটি খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। বাইরের দেশে কোথাও মিউচ্যুয়াল ফান্ড লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস দিতে পারে না। কিন্তু এতদিন আমাদের এদেশে এটা চালু ছিল। এখন রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট পদ্ধতি বাতিল করায় ফান্ডগুলোকে শুধুই নগদ লভ্যাংশ দিতে হবে। এতে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়বে বলে আশা করা যায়।

তিনি বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারে মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো খুবই দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে। এর কারণ ফান্ড ম্যানেজাররা চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তাদের মধ্যে পেশাদারিত্ব তৈরি হয়নি। বাইরের উন্নত পুঁজিবাজারে দেখা যায়, মিউচ্যুয়াল ফান্ড খুব ভালো রিটার্ন দেয়। বাজারের রিটার্ন থেকে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের রিটার্ন অনেক বেশি থাকে। কিন্তু আমাদের এখনে বাজারের রিটার্ন থেকে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের রিটার্ন অনেক কম।

ডিএসই’র পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন জাগো নিউজকে বলেন, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের আচরণ অত্যন্ত অস্বাভাবিক। বাজার যখন বাড়ছিল তখন মিউচ্যুয়াল ফান্ড নামছিল। আর বাজার যখন কমছে মিউচ্যুয়াল ফান্ড তখন বাড়ছে। সত্যিকার অর্থে মিউচ্যুয়াল ফান্ড যে উদ্দেশ্যে পুঁজিবাজারে আনা হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। মিউচ্যুয়াল ফান্ড যারা পরিচালনা করেন তাদের ম্যানেজমেন্ট ব্যর্থ এবং বাজারে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের যে প্রয়োজনীয়তা তা প্রমাণ করতে আমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। এ কারণে মিউচ্যুয়াল ফান্ড বাজারে অস্বাভাবিক আচরণ করছে।

মিউচ্যুয়াল ফান্ডের অস্বাভাবিক আচরণের পেছনে সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে- এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, মিউচ্যুয়াল ফান্ড প্রথমদিন থেকেই অস্বাভাবিক আচরণ করছে। ১০ টাকার মিউচ্যুয়াল ফান্ড কিছুতেই ৩০ টাকা হওয়া উচিত ছিল না। অথচ এ বাজারে তা-ই হয়েছে। এটা কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারে না।

ডিএসই’র অপর পরিচালক রকিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের যে দাম বাড়ছে তা কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারে না। মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর এমন দাম বাড়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। ফান্ডগুলোর পোর্টফোলিও দেখলে দেখা যাবে, আজেবাজে শেয়ার কিনে বসে আছে। ফান্ড ম্যানেজাররা অদক্ষ এবং তারা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর এ অবস্থার কারণে সার্বিক পুঁজিবাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তিনি বলেন, ভারতে মিউচ্যুয়াল ফান্ড জমজমাট এবং বাজারকে সাপোর্ট দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের বাজারে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের কোনো ভূমিকা নেই। ফান্ড ম্যানেজাররা কেউ মুরগির খোয়াড়, কেউ গরুর খোয়াড় কিনেছেন। আবার কেউ পারসোনাল লেভেলে লোন দিয়ে বসে আছেন। তাহলে মিউচ্যুয়াল ফান্ড থেকে ভালো কিছু কীভাবে আশা করবেন? ফান্ড ম্যানেজারদের দক্ষতার অভাব রয়েছে। এমনকি তাদের সততা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

এমএএস/এমএআর/পিআর

আরও পড়ুন