ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

গরিবের ঋণে বড় সুদ!

মেসবাহুল হক | প্রকাশিত: ০৪:১৪ পিএম, ১৬ জুলাই ২০১৯

>> প্রতিষ্ঠানগুলোর অদক্ষতা ও অধিক পরিচালন ব্যয়
>> সুদ কমিয়ে ২৪ শতাংশ করার প্রস্তাব
>> উচ্চ সুদে ঋণ দিয়ে উন্নত দেশ গড়া কঠিন

বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে শিল্পঋণে ব্যাংকগুলোকে সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়েছে। সেখানে দরিদ্র মানুষকে দেয়া ক্ষুদ্র ঋণের সুদের হার পড়ছে প্রায় ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকা ঋণ দিয়ে বছরে ২৭ টাকা সুদ নিচ্ছে এনজিওগুলো।

তবে প্রায় নয় বছর ক্ষুদ্র ঋণের এ সুদের হার থাকার পর এটি কমিয়ে ২৪ শতাংশ করতে প্রস্তাব দিয়েছে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ)। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এমআরএ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ১০০ টাকা ঋণ দিয়ে বছরে ২৭ টাকা সুদ নিচ্ছে এনজিওগুলো। এনজিওগুলোর দাবি তাদের তহবিল ব্যবস্থাপনায় ব্যয় অনেক বেশি। যে কারণে ব্যাংকের স্বাভাবিক ঋণের তুলনায় ক্ষুদ্র ঋণে সুদের হার অনেক বেশি। তবে এটি কমিয়ে ২৪ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষুদ্র ঋণের তহবিল ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গড় ব্যয় ১১ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর গড় ব্যয় অনেক বেশি। ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যয় প্রবণতাই মূলত প্রতিষ্ঠানগুলোর অদক্ষতা ও অত্যধিক পরিচালন ব্যয়ের জন্য দায়ী। বিশেষ করে বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয়, কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ, সম্পদ অর্জন- নানা কারণে পরিচালন ব্যয় বেড়েছে। এসব ক্ষেত্রে যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত পরিবর্তন এনে ক্ষুদ্র ঋণের সুদের হার কমানো সম্ভব।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এনজিওগুলোকে অনেক সময় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ দিতে হয়। এছাড়া এনজিও থেকে যেসব গ্রাহক ঋণ নেয় তারা খুব অল্প পরিমাণে অর্থ নেয়। তাই তাদের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যায়। এসব দিক বিবেচনা করলে ২৪ শতাংশ সুদ খুব বেশি নয়। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বাড়ানো এবং পরিচালন ব্যয় কমানো গেলে এ সুদহার কমানো সম্ভব।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল বায়েস বলেন, গ্রামীণ ঋণ প্রদানে এখনও সরকারি ব্যবস্থা কার্যকরভাবে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে একক নিয়ন্ত্রণের কারণে উচ্চ সুদে ঋণ দিচ্ছে এনজিওগুলো। আবার ব্যাংকগুলো থেকে গ্রামীণ কিছু মানুষ ঋণ পাচ্ছে। কিন্তু এ দুই মাধ্যমে ব্যবস্থাগত কিছু ত্রুটি থাকায় গ্রামের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ ঋণ পাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, ফলে বড় একটি অংশ ঋণের বাইরে থাকছে কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঋণ গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে। এ অবস্থায় বাণিজ্যিক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মোট ঋণ যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি গ্রহীতার সংখ্যাও বাড়াতে হবে। গ্রামের বিপুলসংখ্যক মানুষকে ঋণের বাইরে রেখে কিংবা উচ্চ সুদে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ দিয়ে উন্নত দেশ গড়া কঠিন হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এমআরএ’র প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতায় এ সেক্টরের সার্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করে ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর সার্কুলার জারির মাধ্যমে এনজিও কর্তৃক বিতরণকৃত ক্ষুদ্র ঋণের সার্ভিস চার্জের হার ক্রমহ্রাসমান স্থিতি পদ্ধতিতে ২৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। ওই সার্কুলারে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে সার্ভিস চার্জের হার কমিয়ে আনার বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে বলা হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় এমআরএ’র পরিচালনা বোর্ডের ৪৬তম সভার সিদ্ধান্তক্রমে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত ঋণের সার্ভিস চার্জের হার যৌক্তিকীকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নের জন্য পিকেএসএফ চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদকে সভাপতি করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিসহ মোট আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটির প্রথম সভায় কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশকে কনভেনর করে পাঁচ সদস্যের একটি ব্যয়-বিশ্লেষণ কমিটি গঠন করা হয়। ব্যয়-বিশ্লেষণ কমিটি কর্তৃক দাখিলকৃত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে সার্ভিস চার্জ যৌক্তিকীকরণ বিষয়ক কমিটি বেশকিছু সুপারিশ প্রদান করে।

সুপারিশগুলো হচ্ছে, ২০১৭ সালের ৩০ জুনের ঋণস্থিতির ভিত্তিতে ২৫ কোটি টাকার কম ঋণস্থিতির প্রতিষ্ঠানকে ছোট এবং ২৫ কোটি টাকা এবং তদূর্ধ্ব ঋণস্থিতির প্রতিষ্ঠানকে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হবে। ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্ভিস চার্জের হার ক্রমহ্রাসমান স্থিতি পদ্ধতিতে ২৩ শতাংশ নির্ধারণ করা যেতে পারে। উল্লিখিত হার দুই বছর পর পুনরায় পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

বৃহৎ প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রতি বছর ঋণ কার্যক্রম হতে সৃষ্ট নিট উদ্বৃত্তের ১৫ শতাংশ হারে ক্ষুদ্র ঋণগ্রাহক ও গ্রাহকদের পরিবারের জন্যে সামাজিক দায়বদ্ধতার কাজে ব্যয়ের বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে। এ বাধ্যবাধকতা ছোট প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

পরবর্তীতে বিষয়টি অথরিটির পরিচালনা বোর্ডের ৪৭তম সভায় উপস্থাপন করা হলে বোর্ড ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের ঋণস্থিতির পরিমাণ ১০ কোটি টাকার কম, ১০ থেকে ১০০ কোটি টাকা, ১০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা এবং ৫০০ কোটি টাকার অধিক এ-রূপ চারটি গ্রুপে প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিভাজন করত প্রত্যেক গ্রুপের মার্কেট শেয়ার, উচ্চতর এবং নিম্নতর ব্যয়ের মধ্যে বিচ্যুতি ইত্যাদি বিশ্লেষণপূর্বক একটি প্রতিবেদন প্রস্তুতকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

পরিচালনা বোর্ডের ওই সিদ্ধান্তের আলোকে মোট গড় ব্যয়ের হার নির্ণয় করে এর সঙ্গে যৌক্তিকভাবে মার্জিন অন্তর্ভুক্ত করে ক্ষুদ্র ঋণের সার্ভিস চার্জের হার নির্ধারণ করার প্রস্তাব অথরিটির পরিচালনা বোর্ডের ৫২তম সভায় উপস্থাপন করা হয়।

বর্ণিত কমিটির সুপারিশ ২০১৭ সালভিত্তিক হওয়ায় বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুদ্র ঋণের গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি এসডিজিএসসহ সরকারের উন্নয়নবিষয়ক বিভিন্ন অভিলক্ষ্য অর্জনে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহের সহায়ক ভূমিকা অব্যাহত রেখে সেক্টরের টেকসই সম্প্রসারণ সহায়ক ক্ষুদ্র ঋণের সার্ভিস চার্জের যৌক্তিক হার নির্ধারণ করা হয়।

এমআরএ সূত্র বলছে, ২০১৮ সালের জুনে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দাখিলকারী ৬৭৯ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণী ও সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় বিশ্লেষণ করে গড় মোট ব্যয়ের হার প্রায় ২০ দশমিক ৬৮ পাওয়া যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমদের উপস্থিতিতে গত ১৯ জুন অনুষ্ঠিত অথরিটির পরিচালনা বোর্ডের ৫৩তম সভায় উক্ত মোট ব্যয়ের হারের সঙ্গে যৌক্তিকভাবে মার্জিন অন্তর্ভুক্ত করে সার্ভিস চার্জের হার পুনঃনির্ধারণ করার প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলে সার্ভিস চার্জ ২৪ শতাংশ করার ক্ষেত্রে বোর্ড একমত পোষণ করে।

বিদ্যমান বিধি-বিধান অনুযায়ী এক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ নির্ধারণে সরকারের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন বাধ্যবাধকতা রয়েছে তাই প্রস্তাবনাটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠিয়েছে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবনাটি তারা পর্যালোচনা করছে। এছাড়া অর্থমন্ত্রী দেশে না থাকায় এ বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী দেশে ফিরলেই এ বিষয়ে মতামত পাঠাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

এমইউএইচ/বিএ/এমএআর/এমএস

আরও পড়ুন