ঘোষণা মঞ্চের ব্যয় ৪০ হাজার, ছাতার ৮০ হাজার!
একটি ক্যামেরা দিয়ে দুদিনের স্থিরচিত্র তুলতে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। আটটি ছাতা স্থাপনে খরচ ধরা হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। ৫০ হাজার লিফলেট বিতরণে ব্যয় হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। ঘোষণা মঞ্চের জন্য খরচ হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। চট্টগ্রাম বিভাগীয় বীমা মেলা- ২০১৮ এর জন্য বিভিন্ন খাতে এমন খরচ দেখিয়েছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা- বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মেলার মাঠের বিভিন্ন কাজের জন্য এমন অর্থব্যয় হলেও, একাধিক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান এর থেকে কয়েকগুণ কম খরচে এসব কাজ করে দেয়ার জন্য আইডিআরএ-কে প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু সেসব প্রস্তাব বিবেচনায় না নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানটি সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচের বিবরণ দিয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৫ ও ১৬ মার্চ দুদিনব্যাপী চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়াম সংলগ্ন মাঠে বিভাগীয় বীমা মেলা করে আইডিআরএ। মেলার মাঠ ও স্টল প্রস্তুতসহ অন্যান্য কাজের জন্য ‘দি এ্যাড কমিউনিকেশন’, ‘প্লান বি’, ‘ক্রিয়েটিভ’ ও ‘ভিমরুল’ নামের চার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে প্রস্তাব সংগ্রহ করে আইডিআরএ। এরপর ‘দি এ্যাড কমিউনিকেশন’ নামের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়।
অথচ চারটি প্রতিষ্ঠটানের মধ্যে ‘দি এ্যাড কমিউনিকেশন’ খরচের বিবরণ দেয় সবচেয়ে বেশি। প্রতিষ্ঠনটি সব কাজের খাতভিত্তিক বিবরণ তুলে ধরে মোট খরচের প্রস্তাব দেয় ২৮ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা। বাকি তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘প্লান বি’ ২১ লাখ ৫২ হাজার ৪৫০ টাকা, ‘ক্রিয়েটিভ’ ১৮ লাখ ৭৪ হাজার ৪০০ টাকা এবং ‘ভিমরুল’ ১৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯০০ টাকা খরচের বিবরণ দেয়। এরপরও ওই তিন প্রতিষ্ঠানকে উপেক্ষা করে কাজ দেয়া হয় দি এ্যাড কমিউনিকেশন-কে।
মেলার জন্য আইডিআরএ’র খরচের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মেলার একটি ঘোষণা মঞ্চের জন্য ব্যয় করা হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। অথচ ওই ঘোষণা মঞ্চে করে দিতে প্লান বি আট হাজার, ক্রিয়েটিভ তিন হাজার এবং ভিমরুল পাঁচ হাজার টাকা চেয়েছিল আইডিআরএ’র কাছে।
ঘোষণা মঞ্চের মতোই এমন বাড়তি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে একটি ক্যামেরা দিয়ে স্থিরচিত্র তোলার ক্ষেত্রে। একটি ক্যামেরা দিয়ে দুদিনের মেলার স্থিরচিত্র তুলতে খরচ করা হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। অথচ এ কাজের জন্য প্লান বি ১২ হাজার টাকা, ক্রিয়েটিভ আট হাজার টাকা এবং ভিমরুল ১০ হাজার টাকা খরচের প্রস্তাব দেয় আইডিআরএ-কে।
আরও পড়ুন >> যা থাকছে সরকারি চাকুরেদের সমন্বিত বীমা ব্যবস্থায়
স্থিরচিত্রের পাশাপাশি ভিডিওচিত্র ধারণের জন্য দুটি ক্যামেরার জন্য খরচ করা হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রেও অন্য তিন প্রতিষ্ঠান আরও অনেক কম খরচের প্রস্তাব দিয়েছিল। এর মধ্যে ‘প্লান বি’ ২৬ হাজার, ‘ক্রিয়েটিভ’ ২৪ হাজার এবং ‘ভিমরুল’ ১৬ হাজার টাকা খরচ হবে বলে জানিয়েছিল।
এমন বাড়তি অর্থ ব্যয় হয়েছে মেলার লিফলেট বিতরণের জন্যও। দি এ্যাড কমিউনিকেশনের মাধ্যমে ৫০ হাজার লিফলেট বিতরণের জন্য খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। অথচ এ কাজ করে দেয়ার জন্য ‘প্লান বি’ পাঁচ হাজার এবং ‘ভিমরুল’ আট হাজার টাকা চেয়েছিল।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, মেলার মাঠে আটটি ছাতা ‘ক্রিয়েটিভ’ ১৫ হাজার টাকা এবং ‘ভিমরুল’ ২৪ হাজার টাকায় স্থাপন করে দেয়ার জন্য আইডিআরএ-কে প্রস্তাব দেয়। এজন্য দি এ্যাড কমিউনিকেশন প্রস্তাব দেয় ৮০ হাজার টাকা। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে উপেক্ষা করে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা- আইডিআরএ এ্যাড কমিউনিকেশনের প্রস্তাবিত খরচ অনুমোদন করে। তবে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানটি মেলার মাঠে ছাতা স্থাপন না করায় ওই বিল পরিশোধ করা হয়নি।
আটজনের মঞ্চ টেবিল করে দেয়ার জন্য প্লান বি এক হাজার টাকা এবং ক্রিয়েটিভ তিন হাজার টাকা চেয়েছিল। তবে এ্যাড কমিউনিকেশনের মাধ্যমে আইডিআরএ এ কাজ করেছে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে। র্যালিতে ব্যান্ড পার্টির জন্য আইডিআরএ খরচ করেছে ৩০ হাজার টাকা। তবে ওই ব্যান্ড পার্টির জন্য প্লান বি ছয় হাজার, ক্রিয়েটিভ ২০ হাজার এবং ভিমরুল পাঁচ হাজার টাকা খরচ হবে বলে আইডিআরএ-কে প্রস্তাব দিয়েছিল।
একইভাবে দুই লাইন সোফার জন্য খরচ করা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। তবে এ কাজে প্লান বি ১১ হাজার এবং ক্রিয়েটিভ ১২ হাজার টাকায় করে দিতে চেয়েছিল। দর্শকদের ৫০০টি চেয়ারের জন্য খরচ করা হয়েছে ১২ হাজার টাকা। অথচ এজন্য প্লান বি পাঁচ হাজার এবং ক্রিয়েটিভ চার হাজার টাকা চেয়েছিল।
আরও পড়ুন >> ১৭ হাজার টাকা দিয়ে মিলল ৩ লাখ টাকা
মেলার দুটি গেটের জন্য খরচ হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। যে গেট প্লান বি ও ক্রিয়েটিভ এক লাখ টাকা এবং ভিমরুল ৬০ হাজার টাকায় করে দিতে চেয়েছিল।
এদিকে চার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বোচ্চ খরচের বিবরণ তুলে ধরা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হলেও যেভাবে কাজ করার কথা তা করেনি প্রতিষ্ঠানটি। আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, মেলার মাঠে যে কয়টি ফেস্টুন স্থাপন করার কথা তা করা হয়নি। আটটি ছাতা স্থাপনের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। আবার মেলার মাঠে কার্পেট দেয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। উল্টো কার্পেটের পরিবর্তে ইট বিছিয়ে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয়েছে। আইডিআরএ’র বাছায় কমিটিতে বিষয়টি ধরা পড়ায় বিলটি আটকে দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামে বীমা মেলা করতে আইডিআরএ’র আয়োজক কমিটিতে ছিলেন ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্লাহ, ন্যাশনাল লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জামাল আবু নাছের, পপুলার লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম ইউসুফ আলী, সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের জিএম আমিনুল ইসলাম এবং আইডিআরএ’র কয়েকজন সদস্য ছিলেন।
যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএ’র সদস্য ও মুখপাত্র গোকুল চাঁদ দাশ জাগো নিউজকে বলেন, সবসময় সর্বনিম্ন দরদতা কাজ পাবে, তা ঠিক নয়। এগুলো মেধাভিত্তিক কাজ। আমি দেখব, আমার কোয়ালিটিটা কী?
আরও পড়ুন >> বাজেটে বীমা খাতের নয় প্রস্তাব
জাগো নিউজের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের যেসব কাজ করার কথা, তা করা হয়নি। যেমন- ছাতা স্থাপন করা হয়নি, মেলার মাঠে কার্পেট দেয়ার কথা তাও দেয়া হয়নি। এর উত্তরে আইডিআরএ’র এ সদস্য বলেন, মেলার মাঠে তারা ছাতার বদলে অন্য কিছু দিয়েছে। কারপেটের বদলে ইট দিয়েছে।
ঘোষণা মঞ্চের জন্য ৪০ হাজার টাকা খরচের বিষয়ে তিনি বলেন, যে ঘোষণা মঞ্চের জন্য ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে, সেটা সেই মানের ছিল। অন্য যে প্রতিষ্ঠান প্লান দিয়েছিল, তা আমাদের মনে ধরেনি।
যোগাযোগ করা হলে মেলা আয়োজক কমিটির সদস্য ও ন্যাশনাল লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জামাল আবু নাসের জাগো নিউজকে বলেন, আমি কমিটিতে ছিলাম, ঠিক আছে। কিন্তু দরপ্রস্তাব কীভাবে মূল্যায়ন হয়েছে তা আমি বলতে পারব না। এছাড়া কোথায়, কী খরচ হয়েছে তা তো আমার জানার কথা নয়।
এমএএস/এমএআর/এমকেএইচ