খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ জানতে ৬ ব্যাংককে চিঠি
>> জনতা, অগ্রণী, রূপালী, সোনালী, বেসিক ও বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ উদ্বেগজনক
>> ৫ কর্মদিবসের মধ্যে জবাব চায় অর্থ মন্ত্রণালয়
>> কমানোর নির্দেশনার পরও বেড়েছে খেলাপি ঋণ
>> তিন ৩ বছরে ঋণ বেড়েছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা
ঋণখেলাপিদের জন্য বড় সুবিধা আসছে- এমন ঘোষণায় তিন মাসেই দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। এত বেশি খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিকে উদ্বেগজনক বলছে খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় খেলাপির সংখ্যা ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ অতিমাত্রায় বাড়ার কারণ চিহ্নিতকরণ এবং তা থেকে উত্তরণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে সেটি আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানানোর নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
রোববার (২৩ জুন) আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব মো. জেহাদ উদ্দিন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্য ও বিশেষায়িত ছয় ব্যাংকের সিইও এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে- জনতা, অগ্রণী, রূপালী, সোনালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)।
আরও পড়ুন : খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না : অর্থমন্ত্রী
ব্যাংকগুলোর সিইও এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রাপ্ত ঋণ হিসাব বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যাংকসমূহের ঋণখেলাপির সংখ্যা এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০১৯ এর মার্চ প্রান্তিকে উদ্বেগজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংকসমূহকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ গ্রহণযোগ্য সীমায় কমিয়ে আনার জন্য কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশনা প্রদার করা সত্ত্বেও এ তিন মাসে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ হাজার ১৮৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা; অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৯৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা; রূপালী ব্যাংকে ২৩৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা; সোনালী ব্যাংকে বেড়েছে ১৭৬ কোটি ২০ লাখ টাকা; বেসিক ব্যাংকে বেড়েছে ১৭২ কোটি ২৭ লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে বেড়েছে ১৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, যা মোটেই কাম্য নয়। এছাড়া দেখা গেছে গত তিন বছরে খেলাপি ঋণের সংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশে গত তিন বছরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৩ হাজার ২১০ কোটি টাকা বেড়েছে বলে জানা গেছে। গত শনিবার জাতীয় সংসদে ওয়ার্কার্স পার্টির সংসদ সদস্য লুৎফুন নেসার এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এসে এর পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৩১৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা।’ এ তিন বছরের মধ্যে নতুন করে ৫৮ হাজার ৪৩৬ ব্যক্তি ঋণখেলাপির তালিকায় যুক্ত হয়েছেন বলেও জানান অর্থমন্ত্রী।
নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেয়ার পরই ঘোষণা দেন খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না। এরপর থেকে খেলাপি ঋণ কমাতে নানা ফাঁকফোকর খুঁজতে থাকে সরকার। কিন্তু তারপরও কমেনি খেলাপি ঋণ, উল্টো বেড়েছে।
আরও পড়ুন : শীর্ষ ঋণখেলাপিদের নাম ও ঠিকানা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর ২০১৮ শেষে ছিল ৯৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অব্যবস্থাপনা ও নানা অনিয়মে দেয়া ঋণ আর আদায় হচ্ছে না। অন্যদিকে বিশেষ সুবিধায় পুনর্গঠন করা ঋণ আবার খেলাপি হচ্ছে। ফলে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এতে জনগণের আমানত গ্রহণ করলেও তার সুরক্ষা দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের মার্চ মাস শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক (সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল) ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৩২ দশমিক ২০ শতাংশ। এ সময় ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণ দাঁড়ায় এক লাখ ৬৭ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ছিল ৪৮ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা।
মার্চ শেষে বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আলোচিত সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৭ লাখ পাঁচ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৯ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকাই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। যা মোট ঋণের ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। এ ছাড়া বিদেশি ৯ ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ৩৬ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দুই হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ২০ শতাংশ।
আরও পড়ুন : শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপির কাছে ৫১ হাজার কোটি টাকা
নিয়ম অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ তিনটি শ্রেণিতে বিভাজন করা হয়। একটি নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দ বা ক্ষতিজনক মান। মন্দ বা ক্ষতিজনক মানের ঋণ আদায় হবে না বলে ধারণা করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশির ভাগই আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশন সংরক্ষণ। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। এ ছাড়া নিম্নমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। এতে কমছে মুনাফা। ফলে খেলাপির কারণে মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে গতকাল শনিবার দেশের ৩০০ শীর্ষ ঋণ খেলাপির তালিকা সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ওই তালিকা উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘এদের ঋণ খেলাপির পরিমাণ ৫০ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ ঋণ খেলাপিরা সরকারি ও বেসরকারি খাতের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছেন।’
মন্ত্রী জানান, এসব ঋণ খেলাপির কাছে পাওনার পরিমাণ ৭০ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা আর শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ৫২ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা।
শীর্ষ ১০ ঋণ খেলাপি হলো—সামানাজ সুপার ওয়েল লিমিটেড (১ হাজার ৪৯ কোটি টাকা) গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডাইং লিমিটেড (৯৮৪ কোটি টাকা), রিমেক্স ফুডওয়্যার লিমিটেড (৯৭৬ কোটি টাকা), কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেম লিমিটেড (৮২৮ কোটি টাকা), মাহিন এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড (৮২৫ কোটি টাকা), রূপালী কম্পোজিট লেদার ওয়্যার লিমিটেড (৭৯৮ কোটি টাকা), ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেড (৭৭৬ কোটি টাকা), এসএ ওয়েল রিফাইনারি লিমিটেড (৭০৭ কোটি টাকা), সুপ্রভ কম্পোজিট নিট লিমিটেড (৬১০ কোটি টাকা) ও গ্রামীণ শক্তি (৬০১ কোটি টাকা)।
সেই সঙ্গে পাঁচ কোটি টাকার বেশি ঋণ গ্রহিতাদের মধ্যে পাঁচ কোটি বা কম পাওনা থাকাদের তালিকাও প্রকাশ করেন মুস্তফা কামাল। এ তালিকায় দেখা যায়, ২০০৯ সাল থেকে ১৪ হাজার ৬১৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। খেলাপি হয়েছে ১ লাখ ১৮৩ কোটি টাকা।
এমইউএইচ/এনডিএস/এমএস