এক বছরেই ২৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল
২০১৮ সালে দেশের ব্যাংকগুলোতে ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করা হয়েছে। যা তার আগের বছরের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। এভাবে গত পাঁচ বছরে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০১৮ এ তথ্য উঠে এসেছে। মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০১৮ নামে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। যার মোড়ক উন্মোচন করেছেন গভর্নর ফজলে কবির।
জানা গেছে, সম্ভাব্য খেলাপি হওয়া থেকে বিরত থাকতে এবং খেলাপি হওয়ার পর তা নিয়মিত করতে পুনঃতফসিল করেন ঋণগ্রহীতারা। পুনঃতফসিল করতে নির্ধারিত হারে নগদ ডাউন পেমেন্ট দেয়ার নিয়ম রয়েছে। ২০১২ সালে ঋণ পুনঃতফসিলের পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা জারি করা হয়। তবে ২০১৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিবেচনায় শিথিল শর্তে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়া হয়।
এর পরের বছর থেকে ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনঃতফসিলের গতি বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। ২০১৪ সালে ১২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পেয়েছিলেন খেলাপি গ্রাহকরা। এরপর ২০১৫ সালে ১৯ হাজার ১৪০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। ২০১৬ সালে ১৫ হাজার ৪২০ কোটি টাকা এবং ২০১৭ সালে ১৯ হাজার ১২০ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ পান খেলাপি গ্রাহকরা। সব মিলিয়ে গত পাঁচ বছরে ৮৯ হাজার ২৪০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করেছে ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকাররা বলছেন, প্রভাবশালী গ্রাহকদের চাপের মুখে পুনঃতফসিল সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংক। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি পুনঃতফসিল করা হয়েছে। পুনঃতফসিল সুবিধার ৫৮ শতাংশই ভোগ করেছেন বড় বড় শিল্পপতিরা।
এদিকে সর্বশেষ গত ১৬ মে খেলাপিদের দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সুদহারে ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বিষয়টির ওপর হাইকোর্ট স্থিতাবস্থা জারি করেন। ফলে ২২ মে ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধা বাস্তবায়ন না করার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আগ্রাসীভাবে ঋণ বিতরণ করায় ব্যাংকগুলোর সুদ আয় অনেক বেড়েছে। গত বছর ব্যাংকগুলোর সুদ আয় হয়েছে ৮৬ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। আগের বছর এই আয় ছিল ৭০ হাজার ৬১০ কোটি টাকা।
এক বছরের ব্যবধানে সুদ আয় বেড়েছে ১৫ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা বা ২২ শতাংশ। আমানতের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করার গত বছর ব্যাংকগুলোর মোট আয় দাঁড়িয়েছে ৫৫ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। আগের বছর মোট আয় ছিল ৫১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এই আয় থেকে অর্থ নিয়ে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয়েছে ৫০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর আয় খেয়ে ফেলেছে।
ব্যাংকগুলোর সুদ আয় ও মোট আয় গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রতিবছরই আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু প্রকৃত মুনাফা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হয়েছে ২০১৮ সালে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে পরিচালন মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় আট শতাংশ বেশি। আগের বছর পরিচালন মুনাফা হয় ২৪ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে গিয়ে নিট মুনাফা সাড়ে ৫৭ শতাংশ কমেছে। ২০১৮ সালে নিট মুনাফা হয়েছে চার হাজার ৪০ কোটি টাকা। অথচ ২০১৭ সালে নিট মুনাফা ছিল ৯ হাজার ৫১০ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে হয় আট হাজার ৩১০ কোটি টাকা এবং ২০১৫ সালে ব্যাংকগুলোর মুনাফা হয় সাত হাজার ৯২০ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঋণ কয়েকটি গ্রুপের কাছে কেন্দ্রীভূত। তেমনি ব্যাংকিং কার্যক্রমও কয়েকটি ব্যাংকের কাছে কেন্দ্রীভূত। গত বছর ব্যাংকগুলোর আমানতের পরিমান দাঁড়িয়েছি ১০ লাখ ৭৯ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। আমানতের তিন লাখ ৫২ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা বা ৩৩ শতাংশ রয়েছে পাঁচ ব্যাংকের কাছে। ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ ৯ লাখ এক হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। এই ঋণের ২৬ শতাংশই পেয়েছেন বড় শিল্পের মালিকরা। আমদানি-রফতানিকারকরা পেয়েছেন মোট ঋণের ১৫ শতাংশ। আবার বিতরণকৃত ঋণের ৩১ শতাংশ দিয়েছে পাঁচ ব্যাংক। ঋণ কার্যক্রমে অনিয়ম-জালিয়াতির ঘটনা অব্যাহত থাকায় খেলাপিঋণও বাড়ছে।
২০১৭ সালে খেলাপি ছিল ৭৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। গত বছর তা দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকায়। খেলাপি ঋণের ৫১ শতাংশই রয়েছে পাঁচ ব্যাংকে। যার পরিমাণ ৪৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণের ১২ শতাংশ তৈরি পোশাক খাতে, আট শতাংশ বস্ত্রশিল্পে এবং ১৬ শতাংশ বড় শিল্পে কেন্দ্রীভূত।
প্রতিবেদনে তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলো কাগুজে আদায় বেশি দেখিয়েছে। অবলোপন, পুনঃতফসিল, সুদ মওকুফ ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ৫২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে। এর মধ্যে শুধু ২০১৮ সালে অবলোপন করা হয়েছে চার হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। তবে এই সময় পর্যন্ত আদায় করেছে ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ৪০ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
এদিকে ব্যাংকের আমানত ও ঋণের প্রবৃদ্ধির ব্যবধান বাড়ছে। ২০১৪ সালে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ, অন্যদিকে আমানত বাড়ে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৭ সালে ঋণ ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ বাড়লে আমানত বাড়ে মাত্র ১০ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। সর্বশেষ গত বছর ঋণ বেড়েছে ১৪ শতাংশ আমানত বেড়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ।
প্রতিবেদন প্রকাশকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ২০১৮ সালে সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতের মূলধন পর্যাপ্ততা ও তারল্য ন্যূনতম আবশ্যকীয় হারের চেয়ে বেশি ছিল।
তিনি ব্যাংকিং খাতে পুঞ্জীভূত মন্দঋণ কমাতে ব্যাংকারদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের অনুরোধ জানান। এ ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ উল্লেখ করে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
গভর্নর বলেন, দেশের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে ঋণ ও আমানতের সুদের হার এক অংকে নামিয়ে আনার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের প্রতি আহ্বান জানাই। সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঝুঁকি বিষয়ে সচেতন থাকার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
এসআই/বিএ