বাজেট বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা
উন্নত বিশ্বের মতো সবার জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর একটি সুখবর চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছিল। এর আওতায় সরকারি-বেসরকারি সব কর্মজীবী মানুষকে পেনশন সুবিধায় আনার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল বাজেট বক্তৃতায়। কিন্তু এক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। এখনও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বাস্তবায়নে নীতিমালা চূড়ান্ত করতে পারেনি অর্থ মন্ত্রণালয়।
আরও পড়ুন > ‘বৈষম্য কমাতে সর্বজনীন পেনশন চালু করতে চাই’
তাই আসছে বাজেটেও এ বিষয়ে প্রাথমিক রূপরেখা দেবেন নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ কারণে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য প্রস্তাবিত ‘সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতির খসড়া কাঠামো’ প্রস্তুতের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু এ ব্যবস্থার বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়ে যেমন অর্থনীতিবিদরা তেমনি কবে নাগাদ এ পদ্ধতি কার্যকর হবে তারও কোনো সঠিক সময় বলতে পারেননি অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, এটি বেশ সময় ও ব্যয়-সাপেক্ষ বিষয়। অনেক চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে এ বিষয়ে কাজ করছে অর্থ বিভাগ। এখন শুধু সরকারি চাকরিজীবীরাই মাসিক পেনশন সুবিধা পান। নতুন ব্যবস্থায় এর বাইরে বেসরকারি খাতে নিয়োজিত চাকরিজীবীদের পেনশনের আওতায় আনার পরিকল্পনার কথা বলা হয়।
জানা গেছে, সর্বজনীন পেনশনের খসড়া রূপরেখা তৈরির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আজিজুল আলমের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটি কাজ করছে। শিগগিরই কমিটি এ বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে অর্থমন্ত্রীর কাছে জামা দেবে।
এ বিষয়ে আজিজুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে প্রতিবেদনে সুপারিশ তুলে ধরা হবে। ওই সুপারিশ গ্রহণের পর সরকারের নীতিগত অনুমোদন লাগবে। এরপর বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে।
আরও পড়ুন > বাজেট অধিবেশন শুরু ১১ জুন
তিনি বলেন, সর্বজনীন পেনশনের বিষয়ে প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে সব কর্মজীবী মানুষকে পেনশনের আওতায় আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বর্তমান সরকার।
সূত্র জানায়, সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি ২০০৪ সালে সীমিত আকারে চালু করেছিল ভারত সরকার। কলকাতা ও আসাম ছাড়া বাকি সব রাজ্যে এ ব্যবস্থা বর্তমানে চালু রয়েছে। নেপাল, ভুটান ও শ্রীলংকা এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এর আগেও এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার ওপর একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। ওই প্রস্তাব অনুযায়ী সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় পেনশন তহবিল হবে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। অর্থাৎ চাকরিজীবী ও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে এ তহবিলে অর্থ দেবে। এর পরিমাণ হতে পারে চাকরিজীবীর মূল বেতনের শতকরা ১০ ভাগ। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষও সমপরিমাণ অর্থ দেবে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে একই নিয়মে তহবিল গঠন করা হবে।
পেনশনের এ তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য একটি রেগুলেটরি অথরিটি থাকবে। এ অথরিটির মাধ্যমে পেনশন কার্যক্রম পরিচালিত হবে। প্রস্তাবিত পেনশন স্কিমের আওতায় সরকারি চাকরিজীবীদের বয়স হবে ৬০ বছর। বেসরকারি খাতের জন্য ৬৫ বছর। নির্ধারিত সময়ে চাকরি শেষে অর্ধেক পেনশনের টাকা এককালীন তোলা যাবে। বাকি টাকা তহবিলে থাকবে। সে অর্থ পরবর্তীতে প্রতি মাসে ধাপে ধাপে উঠানো যাবে।
তহবিল পরিচালনার জন্য আলাদা রেগুলেটরি অথরিটি গঠন করা হবে। তারা লাভজনক খাতে তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করবেন। বিনিয়োগ সুরক্ষাও দেয়া হবে। এ থেকে যে মুনাফা আসবে, তার অংশ মাসে মাসে পাবেন সুবিধাভোগীরা। পেনশনভোগীদের স্মার্টকার্ড দেয়া হবে। প্রস্তাবিত পেনশন স্কিমে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের সুবিধা থাকবে।
সূত্র আরও জানায়, সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতির আওতায় বেসরকারি পর্যায়ে প্রাথমিকভাবে বড় বড় কর্পোরেট হাউস, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে কর্মরত চাকরিজীবীদের আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য খাতের প্রতিষ্ঠানকেও আনা হবে।
আরও পড়ুন > ‘যুগোপযোগী বাজেট না হলে জাতীয় সংকট তৈরি হবে’
তবে এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জের বিষয়ে অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, সবার আগে পেনশন তহবিল গঠন করতে হবে। এ তহবিলকে লাভজনক জায়গায় বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে সেক্ষেত্রে বিনিয়োগের বাজার নেই। এছাড়া এ তহবিল দেখাশোনার জন্য অভিজ্ঞ লোকবল লাগবে। সেটারও অভাব রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এ তহবিল পরিচালনার জন্য যে রেগুলেটরি অথরিটি থাকবে সেখানে একজনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিতে হবে। সরকারের প্রথা অনুযায়ী, একজন সচিব অবসরগ্রহণের পর তাকে একটা পজিশন দিতে হয়। তাই তাকে এ অথরিটির চেয়ারম্যান করে দেয়া হলো। কিন্তু তিনি কার্মজীবনে এ ধরনের কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এমনভাবে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা পরিচালনা হতে পারে না।
‘ধরা যাক, আইন অনুযায়ী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ডে পাঁচ লাখ টাকা জমা থাকার কথা। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মী হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। সরকারি অথরিটি ওই প্রতিষ্ঠানে প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য গেল। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বলল, তারা লসে ছিল। কর্মীদের বেতনও দিতে পারিনি। প্রভিডেন্ট ফান্ড কোথায় পাব? তখন কী হবে?’
তিনি বলেন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সার্বিকভাবে কাঠামোগত সংস্কার দরকার। যা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ যেসব দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা চালু হয়েছে, সেখানে কমপক্ষে ছয় থেকে সাত বছর সময় লেগেছে। কাজটি কঠিন হলেও অসম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতির উদ্যোগ ভালো। এতে সরকারি-বেসরকারি পেনশনভোগীরা উপকৃত হবেন। তবে সরকারি খাতে সহজ হলেও বেসরকারি খাতে এর বাস্তবায়ন কঠিন হবে বলে মনে করি।
‘কারণ বেসরকারি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে সরকারকে। বেসরকারি কর্তৃপক্ষ রাজি না হলে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন কঠিন হবে।’
আরও পড়ুন > এডিপি : কোন খাতে বরাদ্দ কত
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ, যা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ। তারা পেনশন সুবিধা পান। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের ৯৫ শতাংশের মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। তাদের কোনো পেনশন সুবিধা নেই। দেশে গড় আয়ু ও প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ার কারণে সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি বেড়েছে। এ ঝুঁকি মোকাবিলা ও সমতা বিধান সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার।
এমইউএইচ/এমএআর/জেআইএম