কপারটেকের ব্যালেন্স শিট পরীক্ষা করবে ডিএসই
অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তির অপেক্ষায় থাকা কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যালেন্স শিট পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাক স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।
বৃহস্পতিবার (৯ মে) অনুষ্ঠিত ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মো. রকিবুর রহমান।
পর্ষদ সভা শেষে রকিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, কপারটেক নিয়ে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) থেকে অভিযোগ আকারে একটি অবজারভেশন (পর্যবেক্ষণ) পাঠানো হয়েছে। সেই সঙ্গে গণমাধ্যমেও কপারটেক নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর ভিত্তিতে ডিএসইর পক্ষ থেকে কপারটেকের পুরো আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখা হবে। তারপর তা বোর্ডে নিয়ে আসা হবে।
এর আগে নাহি অ্যালুমিনিয়াম, বিবিএস কেবলস, ওরিয়ন ফার্মার বিষয়ে ডিএসই থেকে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলেও পরবর্তীতে আর ডিএসইর প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি- এ বিষয়ে সাংবাদিকরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, আগের মতো এবার প্রতিবেদন হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কপারপটেকের বিষয়ে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা সফলতার মুখ দেখবে। প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজকে তালিকাভুক্ত করা হবে না।
কপারটেকের অনিয়মের বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বোর্ডের যতটুকু ক্ষমতা আছে ততোটুকু করবে। যেসব অনিয়ম পাওয়া যাবে তা পুনর্বিবেচনার জন্য আমরা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পাঠাব।
গত বছরের ডিসেম্বরে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে ২ কোটি সাধারণ শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজকে ২০ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেয় বিএসইসি। বিএসইসির অনুমোদ নিয়ে ইতোমধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) আবেদন গ্রহণ করছে কোম্পানিটি।
তবে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। প্রতিবেদনে রয়েছে নানা গড়মিল। কপারটেকের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ হিসাব বছরের শুরুতে আদায়যোগ্য নগদ অর্থ বা রিসেভেবলস ছিল প্রায় ২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ওই বছরে পণ্য বিক্রি হয় ৫২ কোটি ৬৬ লাখ টাকার। পণ্য বিক্রি থেকে নগদ আদায় ৫০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। উপরন্তু অগ্রিম বিক্রি আরও প্রায় ৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এ হিসাবে ক্লোজিং রিসেভেবল হওয়ার কথা ৯ কোটি ৮ লাখ টাকা।
কিন্তু আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। একইভাবে আর্থিক প্রতিবেদনে দেনা হিসাবে ৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা দেখালেও কাঁচামাল ক্রয় এবং এর বিপরীতে পরিশোধ হিসাব করলে অঙ্কটা দাঁড়ায় ৪ কোটি ২২ লাখ টাকা।
কপারটেকের দেয়া তথ্যে ২০১৬-১৭ হিসাব বছরের তুলনায় ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৩৩ শতাংশ কমলেও সুদব্যয় বেড়েছে ২৩ শতাংশ। ২০১৭ সালে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল প্রায় ৩৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে তা নামে ২৬ কোটি টাকায়। কিন্তু আগের বছর যেখানে এ ঋণের বিপরীতে পৌনে ২ কোটি টাকা সুদ পরিশোধ করে, গত বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ কোটি ১২ লাখ টাকা।
একইভাবে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ১৭ শতাংশ কমার বিপরীতে সুদ ব্যয় বেড়েছে ৪৬১ শতাংশ। সার্বিক হিসাবে ঋণ ২৬ শতাংশ কমলেও সুদ ব্যয় বেড়েছে ১৩৩ শতাংশ। এছাড়া লিজ ঋণ ৪৫ শতাংশ বাড়লেও সুদব্যয় বেড়েছে ৫ হাজার শতাংশ। অর্থাৎ একদিকে কোম্পানির ঋণ কমেছে, কিন্তু বেড়েছে সুদ পরিশোধের পরিমাণ। এ বৈপরীত্যের বিষয়ে কোম্পানি বা অডিটরের কোনো ব্যাখ্যা বা পর্যবেক্ষণ নেই।
দেখা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সমাপ্ত হিসাব বছরের প্রতিটিতে বিক্রয় কার্যক্রমে খরচ মোট বিক্রির ৭৫ শতাংশ। বিক্রয় বাড়লেও কী করে প্রতি বছর খরচ ৭৫ শতাংশই হলো, তার ব্যাখ্যা নেই। কপারটেক প্রতি হিসাব বছর শেষে মজুদ পণ্যের যে দাম উল্লেখ করেছে, তাও অবিশ্বাস্য।
গত হিসাব বছরে যেখানে মোট টার্নওভার ছিল ৫২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, সেখানে এর ইনভেনটরিজ ৩২ কোটি টাকার। ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে যেখানে টার্নওভার ছিল পৌনে ৯ কোটি টাকারও কম, সেখানে ইনভেনটরিজ ছিল পৌনে ১০ কোটি টাকার। মাঝের বছরগুলোর তথ্যও একই রকম। এমন তথ্য বলছে, কোম্পানিটি তার বাজার চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি পণ্য উৎপাদন করছে, যা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়।
কপারটেক আইপিওতে আসার মাত্র দেড় বছর আগে রাতারাতি পরিশোধিত মূলধন ১৫ গুণ বা ১৫০০ শতাংশ বাড়িয়ে ৪০ কোটি টাকা করেছে। এ সময়ে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা বেড়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ আইপিওতে আসার লক্ষ্য নিয়ে অযথা শেয়ার বাড়িয়েছে। ২০১৪ সালে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে আসা কপারটেকের মালিক পক্ষ নিজেদের শেয়ার বাড়ানোর পাশাপাশি প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় প্রায় ২২ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন। এতে আইপিও-পরবর্তী সময়ে মালিক পক্ষের মালিকানা ৩০ শতাংশে নেমেছে।
এমএএস/এমবিআর/এমকেএইচ