নকল তামাক পণ্য : হুমকিতে জনস্বাস্থ্য, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
নকল তামাক পণ্যে বাজার সয়লাব হচ্ছে। মানবদেহের জন্য তামাকজাত পণ্য এমনিতেই মারাত্মক ক্ষতিকর। তার ওপর এসব নকল তামাকজাত পণ্যে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। পাশাপাশি হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এবং রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতি বছর বাজেটে সিগারেটের ওপর করারোপ করা হচ্ছে। কিন্তু কর প্রদানে জটিলতা এবং কর না দিয়ে নকল পণ্য বাজারজাত হওয়ায় রাজস্ব আয় আশানুরূপ বাড়ছে না। অন্যদিকে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে কম দামি অবৈধ সিগারেটের বাজার। রাজস্ব ফাঁকি দেয়া এসব অবৈধ ও নিম্নমানের সিগারেট সরকার নির্ধারিত মূল্যের কোনো তোয়াক্কা না করে বাজারে হরহামেশাই বিক্রি হচ্ছে। ফলে কম দামি এসব সিগারেটের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন স্বল্প আয়ের ধূমপায়ীরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এসব অবৈধ সিগারেটের বাজার থেকে সরকার প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে, যা তামাক খাত থেকে পাওয়া মোট রাজস্বের প্রায় ১০ শতাংশ। জটিল কর কাঠামো, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও সার্বিক তদারকির অভাবে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অবৈধ সিগারেটের এই বাজার বাড়ছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে অবৈধ সিগারেটের প্রায় ৯২ ভাগই রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের প্রবণতাকে উসকে দিচ্ছে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রাজস্ব ফাঁকি দেয়া অবৈধ সিগারেট।
জানা গেছে, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহের বিভিন্ন বাজারে স্বল্প আয়ের ধূমপায়ীদের টার্গেট করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় ৩০টি কোম্পানি অবৈধভাবে ৫০টির বেশি ব্র্যান্ডের সিগারেট উৎপাদন করছে। এসব সিগারেটের প্যাকেটে নকল ও পুনঃব্যবহৃত ট্যাক্স স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে বাজারজাত করা হচ্ছে।
অথচ ট্যাক্স স্ট্যাম্প পুনর্ব্যবহার ও নকল সিগারেট উৎপাদন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন বাংলাদেশ লিমিটেড ট্যাক্স স্ট্যাম্প উৎপাদনকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান। কেউ যদি অন্য কোথাও ট্যাক্স স্ট্যাম্প/ব্যান্ডরোল উৎপাদন অথবা পুনর্ব্যবহার করে তাহলে সেটা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং নকল টাকা তৈরির মতোই বড় অপরাধ।
এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে যে, ধান খেতের মাঝখানে, রাইসমিলে আড়ালে অবৈধ সিগারেট উৎপাদন করা হচ্ছে। ফলে এ অবৈধ সিগারেটে বাজার ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
অবৈধ সিগারেট উৎপাদনের জন্য নেয়ার পথে টাঙ্গাইলে তিন টন তামাকসহ একটি ট্রাক গতকাল রোববার (২১ এপ্রিল) জব্দ করেছে এনবিআরের ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট বিভাগের একটি দল। ট্রাকটির চালান পরীক্ষা করে দেখা যায় এতে তামাকের ডাস্ট বা উচ্ছিষ্ট রয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে প্রক্রিয়াজাত তামাক। ট্রাকসহ জব্দকৃত তামাকের মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা। প্রক্রিয়াজাতকৃত এই তামাক সিগারেট বানানোর কাজে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারযোগ্য বলে এনবিআরের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে।
ট্রাকটি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থেকে ময়মনসিংহের দিকে যাচ্ছিল বলে ধারণা করা হয়। গোপন সংবাদের ওপর ভিত্তি করে ঢাকা পশ্চিম ভ্যাটের একটি দল ট্রাকের ওপর নজরদারি করে। ট্রাকটি বঙ্গবন্ধু সেতু অতিক্রম করে সেতুর পূর্ব প্রান্তে আসার পর স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় ট্রাকটির গতিরোধ করে কাগজপত্র যাচাই করা হয়। ট্রাক চালান অনুযায়ী চালানটি নেত্রকোনায় রহমান ট্রেডার্সের নামে আনা হয়েছে। ওই চালান যাচাই করে দেখা যায় প্রাপকের ঠিকানা ভুয়া।
ট্রাকটিতে অনুসন্ধান চালিয়ে কুষ্টিয়ার ত্রিমোহনীর বড়খাদা এলাকার গ্লোবাল লিফ টোব্যাকোর চালানপত্র পেয়েছেন অভিযানকারী কর্মকর্তারা। এখানে যথাযথ ভ্যাট চালান বহন করা হয়নি।
ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে সিগারেট উৎপাদনের জন্য মিথ্যা চালানের মাধ্যমে কুষ্টিয়া থেকে পণ্য বের করা হয়। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কোনো সিগারেট ফ্যাক্টরিতে ব্যবহারের জন্য এই তামাক আনা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে গত ১১ এপ্রিল ঢাকা পশ্চিম ভ্যাটের একটি দল র্যাবের সহযোগিতায় টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার কামার্থী গ্রামে অটোরাইস মিলের আড়ালে গড়ে ওঠা অবৈধ সিগারেট ফ্যাক্টরির সন্ধান পায়। সে ফ্যাক্টরি থেকে নকল সিগারেট, ফিল্টার, প্রক্রিয়াজাত তামাক ও মেশিনারিজ জব্দ করে। এই ফ্যাক্টরিতে স্থাপিত উন্নতমানের মেশিনারিজ দিয়ে দৈনিক ২০ লাখ শলাকা সিগারেট উৎপাদন করা সম্ভব।
এতে মাসে প্রায় ৫১ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হতো। ওই ফ্যাক্টরি থেকে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর ব্র্যান্ডের নকল সিগারেট উৎপাদন করা হতো। জব্দ করা প্রক্রিয়াজাতকৃত তামাকের সঙ্গে পূর্বের জব্দকৃত তামাকের মিল রয়েছে বলে জানান এনবিআর কর্মকর্তারা। তারা ধারণা করছেন, বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায় আরও অবৈধ ফ্যাক্টরি আছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, ধূমপায়ীর সংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে সরকার প্রতি বছর বাজেটে সিগারেটের দাম বাড়িয়েছে। উচ্চস্তরের সিগারেট থেকে সরকার প্রায় ৮১ শতাংশ এবং নিম্নস্তরের সিগারেট থেকে ৭১ শতাংশ পর্যন্ত রাজস্ব আয় করে। এছাড়া উচ্চ করহারের পাশাপাশি গত তিন অর্থবছরে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। নিম্নস্তরের ১০ শলাকার প্রতি প্যাকেট সিগারেটের দাম ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ১৮ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই প্যাকেটের দাম নির্ধারণ করা হয় ৩৫ টাকা। বর্তমানে এই ৩৫ টাকা প্যাকেটের সিগারেটে প্রায় ২৫ টাকা সরকারকে রাজস্ব দিতে হয়।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া সিগারেটের একই প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ টাকায়। প্রতি শলাকা সিগারেটের দাম পড়ে গড়ে দেড় থেকে দুই টাকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের ধূমপায়ীরা এসব নিম্নমানের সিগারেটের প্রতিই ঝুঁকছেন।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দাম বাড়িয়ে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমানোর বিষয়ে সরকারের লক্ষ্য অর্জনের প্রধান বাধা হলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রাজস্ব ফাঁকি দেয়া সিগারেট তথা নকল তামাকজাত পণ্যের সহজলভ্যতা।
এতে সরকারের রাজস্ব আয় কমার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা তৈরির আশঙ্কা বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সিগারেট খাত থেকে আগামী অর্থবছরগুলোতে ব্যাপক হারে রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। এ বাণিজ্য বন্ধে এনবিআরকে মাঠ পর্যায়ে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
এমইউএইচ/এমবিআর/পিআর