আলো দেখিয়ে অন্ধকারে পুঁজিবাজার
>> ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে মূলধন হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা
>>১১৯৮ কোটি টাকার লেনদেন নেমে এসেছে ২০০ কোটির ঘরে
>> নতুন সরকারের আমলে ডিএসই মূলধন হারিয়েছে ৪৩৯৪ কোটি টাকা
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ধুঁকতে থাকা পুঁজিবাজারে আলোর ঝিলিক দেখা দেয়। টানা বাড়তে থাকে মূল্য সূচক। সেই সঙ্গে লেনদেনেও দেখা দেয় তেজিভাব। বাজারের এমন চাঙাভাবে নতুন করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের সেই স্বপ্ন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
নতুন সরকারের মেয়াদ এক মাস পার না হতেই পতনের কবলে পড়ে দেশের পুঁজিবাজার। প্রায় তিন মাস ধরে এ দরপতন অব্যাহত রয়েছে। এমন দরপতনে এখন অনেকটাই অন্ধকারে নিমজ্জিত বাজার। প্রতিনিয়ত পুঁজি হারানোর আতঙ্কে ভুগছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
আরও পড়ুন >> নীরবে পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় ধরনের রাজনৈতিক হানাহানি ছাড়াই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া এবং সরকারের ধারাবাহিকতা থাকায় পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। তবে বাজারে সংক্রিয় ছিল বিভিন্ন কারসাজি চক্র। এতে ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে দুর্বল প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেশি বাড়ে। বাজারে এমন কারসাজি চললেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তা বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
তারা বলছেন, নির্বাচনের পর প্রথমদিকে বাজারের উত্থান ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে কারসাজি চক্র নিয়ন্ত্রণে নেয় বাজার। এতে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম। বিএসইসি প্রথমদিকে যদি শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতো তাহলে আজ বাজারের এমন অবস্থা হতো না। শুধু নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি নয়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)-ও বাজারের এ দূরবস্থার জন্য দায়ী।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, একদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পুঁজিবাজারে বড় ধরনের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দেয়। ভোটের পর ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত এটি বজায় থাকে। প্রায় এক মাসের ওই ঊর্ধ্বমুখিতায় তালিভুক্ত প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের দাম বাড়ে। এতে এক মাসের মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক ৭০০ পয়েন্টের ওপর বেড়ে যায়। লেনদেন পৌঁছে যায় হাজার কোটি টাকায়।
নির্বাচনের পর প্রায় এক মাস পুঁজিবাজারে এমন আলোর ঝিলিক দেখা দিলেও ২৭ জানুয়ারি থেকে বাজারের ছন্দপতন ঘটা শুরু হয়। দেখা দেয় দরপতন। সেই সঙ্গে কমতে থাকে লেনদেনের পরিমাণ। সাম্প্রতিক সময়ে লেনদেন কমতে কমতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ১৫ মার্চ পর্যন্ত শেষ তিন কার্যদিবসে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২০০ কোটি টাকার ঘরে। ১৪ মার্চের পর ডিএসইর লেনদেন একবারও ৫০০ কোটির ঘর স্পর্শ করতে পারেনি। লেনদেনে এমন খরা দেখা দেয়ার পাশাপাশি ২৭ জানুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক কমেছে ৬৪১ পয়েন্ট।
আরও পড়ুন >> বিএসইসির দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে কারসাজি চক্র
এমন দরপতনে তালিকাভুক্ত তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশের ওপর দাম কমেছে প্রায় দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের। ফলে ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপর মূলধন হারিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এভাবে পুঁজি হারিয়ে চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন তারা। বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছেন। বাজার সংশ্লিষ্টরা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। কিন্তু তাতেও পতনের হাত থেকে রক্ষা মিলছে না।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারের দাম সবচেয়ে বেশি কমা কোম্পানিগুলোর তালিকায় রয়েছে- বিডি অটোকার, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার, কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, নর্দার্ন ইন্স্যুরেন্স, মাইডাস ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, প্রিমিয়ার লিজিং, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স, আইএফআইসি, জুট স্পিনার্স, তুং-হাই নিটিং, মেঘনা পেট, হাক্কানি পাল্প, ন্যাশনাল ফিড, এমারেল্ড অয়েল ও এসএস স্টিল। অথচ নির্বাচনের পর সবকটি কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল বাড়তি।
ডিএসইর এক সদস্য বলেন, উচ্চ প্রিমিয়াম নিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন ইস্যুমূল্যের নিচে। বাজারে কী ধরনের কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার চিন্তা করে দেখা উচিত। বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারের কাট অব প্রাইজ নির্ধারণে যোগ্য বিনিয়োগকারীরা আকাশচুম্বী দাম হাকছেন। অথচ তালিকাভুক্তির পর ওইসব কোম্পানি ইস্যুমূল্যই ধরে রাখতে পারছে না। আবার এমনও কোম্পানি আছে, তালিকাভুক্তির পর কয়েক বছর যেতে না যেতেই তাদের অফিস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, একের পর এক দুর্বল কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। এতে বাজারের উপকার তো হচ্ছেই না বরং আরও ক্ষতি হচ্ছে। আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানিগুলো শেয়ারের যে দাম নিচ্ছে, মূল মার্কেটে সেই দাম বেশিদিন ধরে রাখতে পারছে না। কোম্পানির ব্যবসা ও মুনাফায় ধস নামছে। এতে বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশ মূল মার্কেটে বিনিয়োগ না করে আইপিও করছেন।
আরও পড়ুন >> দরপতন অব্যাহত, বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি
যোগাযোগ করা হলে ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন জাগো নিউজকে বলেন, বাজারে আস্থার জায়গা দুর্বল হয়ে গেছে। এ কারণে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। সেই পরিবর্তনগুলো আনার জন্য আমরা বিএসইসিতে মতামত দেব। আইপিও যেভাবে আসছে সে ব্যাপারে আমাদের অনেক আপত্তি আছে। প্লেসমেন্টের বিষয়ে আমাদের আপত্তি আছে। এমন অনেক বিষয়ে আমাদের আপত্তি আছে। এগুলো আমরা বিএসইসিকে বলব।
বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর রশিদ চৌধুরী বলেন, বাজারের মন্দাভাবের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতিদিন পুঁজি হারাচ্ছেন। নিঃস্ব হয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আত্মহত্যাও করছেন। কিন্তু বিএসইসি বা ডিএসই কেউ পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সবাই ইস্যুয়ারের (কোম্পানি কর্তৃপক্ষ) স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত। অথচ বিএসইসি ও ডিএসইর প্রধান কাজ বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেয়া।
তিনি বলেন, বাজার এখন যেভাবে চলছে তা স্বাভাবিক নয়। এর প্রতিবাদে আমরা নিয়মিত রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছি। আমাদের দাবি, যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে গেছে, সেগুলো সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে বাই-ব্যাক করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় আইন জরুরি।
মূল্য সূচক
নতুন সরকারের মন্ত্রীরা যেদিন দায়িত্ব নেন, সেদিন ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ছিল পাঁচ হাজার ৬৫৫ পয়েন্ট। এরপর টানা বাড়তে বাড়তে ২৪ জানুয়ারি তা পাঁচ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে উঠে যায়। তবে গত আড়াই মাস ধরে অনেকটা টানা দরপতন হওয়ায় ১৫ এপ্রিল লেনদেন শেষে তা দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৩০৯ পয়েন্টে। অর্থাৎ এ সরকারের আমলে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক কমেছে ৩৪৬ পয়েন্ট।
লেনদেন
নতুন সরকারের মন্ত্রীরা যেদিন দায়িত্ব নেন, সেদিন ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৯৬৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এরপর ৮ থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত আট কার্যদিবসের মধ্যে ছয় কার্যদিবসই হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়। অবশ্য নতুন সরকারের মেয়াদে এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে ২৭ জানুয়ারি।
আরও পড়ুন >> চরম আস্থার সংকটে পুঁজিবাজার
ওইদিন ডিএসইতে এক হাজার ১৯৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকার লেনদেন হয়। সেই লেনদেনের পরিমাণ এখন ২০০ কোটি টাকার ঘরে নেমে এসেছে। ১০ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত লেনদেন হওয়া তিন কর্যদিবসে ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২০০ কোটি টাকার ঘরে। এর আগে ২০১৮ সালের মার্চে টানা তিন কার্যদিবসের বেশি লেনদেনের পরিমাণ ২০০ কোটি টাকার ঘরে ছিল।
বাজার মূলধন
নতুন সরকারের মন্ত্রীরা যেদিন দায়িত্ব নেন, সেদিন ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল চার লাখ এক হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। এরপর প্রায় এক মাস পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকায় ২৪ জানুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন চার লাখ ১৯ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকায় পৌঁছে যায়। তবে গত আড়াই মাসের টানা পতনের কারণে ১৫ এপ্রিল লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়ায় তিন লাখ ৯৭ হাজার ১৭২ কোটি টাকায়। এ হিসাবে নতুন সরকারের আমলে ডিএসই বাজার মূলধন হারিয়েছে চার হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা।
এমএএস/এমএআর/এমএস