পিছু ছাড়ছে না জিএসপি
>> যুক্তরাষ্ট্র ২০১৩ সালের ২৭ জুন স্থগিত করে জিএসপি সুবিধা
>> কারণ ‘মানদণ্ড অনুযায়ী উন্নয়ন হয়নি শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ’
>> ব্র্যান্ডিং, ভবিষ্যত রফতানি, বিনিয়োগ আকর্ষণে জিএসপি গুরুত্বপূর্ণ
রানা প্লাজা ধসের পর ২০১৩ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশি পণ্যের অবাধ বাজার সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। শুল্কমুক্ত বিশেষ এ সুবিধা পাঁচ হাজার পণ্যের ক্ষেত্রে ছিল। যদিও তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে এ সুবিধা ছিল না। স্থগিতের আগে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এ সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করতো।
ফলে স্থগিত হওয়া জিএসপি ফিরে পেতে উঠে-পড়ে লাগে সরকার। প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সবাই জিএসপি ইস্যুতে কথা বলেন। জিএসপি সুবিধা বাতিলের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেও দায়ী করা হয়।
জিএসপি সুবিধা বাতিল ও ফিরে পাওয়া নিয়ে দেশের ভেতরে নানা আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র জানায়, কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নতি এবং শ্রমিকদের সংগঠন করার সুযোগসহ ১৬টি শর্ত পূরণ হলে জিএসপি সুবিধা ফেরত দেয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন বার্তায় শর্ত পূরণে তৎপর হয় সরকার। পূরণ করা হয় একে একে সব শর্ত। কিন্তু স্থগিতের পর সাড়ে পাঁচ বছরের বেশি সময়েও জিএসপি সুবিধা ফিরে পায়নি বাংলাদেশ।
শর্ত পূরণের পরও জিএসপি সুবিধা ফিরে না পাওয়ায় গত বছরের আগস্টে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আমরা আর জিএসপি সুবিধা চাই না। কাজেই এ নিয়ে আমরা কোনো আবেদন করব না। এছাড়া আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছি। এটি যখন হবে তখন আমরা এমনিতেই জিএসপি সুবিধা পাব না। কাজেই জিএসপি নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।’
তোফায়েল আহমেদের ওই মন্তব্যের পর গত পাঁচ মাসে অনেকটাই আড়ালে চলে যায় জিএসপি ইস্যু। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন দায়িত্ব পাওয়া মন্ত্রী টিপু মুনশি আবারও বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। সোনারগাঁ হোটেলে গতকাল বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বাণিজমন্ত্রী জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলারের সহায়তা চান।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে উদ্দেশ্য করে টিপু মুনশি বলেন, জিএসপি আমাদের ইমেজের সঙ্গে জড়িত। জিএসপি স্থগিত হওয়ায় আমরা ইমেজ সংকটে আছি। আমি খুবই আশাবাদী ভবিষ্যতে বিষয়টির সমাধান হবে।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত হতাশ হলেও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও এক সময় জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়া যাবে এমন আশার কথা শুনিয়েছিলেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে সচিবালয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ওয়াশিংটনডিসিতে ইউএসটিআর অফিসে টিকফা’র (আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম) বৈঠকে যেহেতু তারা (যুক্তরাষ্ট্র) সন্তোষ প্রকাশ করেছে, আমরা আমাদের শর্তগুলো পূরণ করেছি, জিএসপি সুবিধা ফিরে না পাওয়ার কারণ নেই। আমরা আশাবাদী, জিএসপি সুবিধা ফিরে পাব।
তবে ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং পরের বছর রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংগঠন ‘আমেরিকান অর্গানাইজেশন অব লেবার-কংগ্রেস ফর ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (এএফএল-সিআইও)-এর আবেদনে ২০১৩ সালে স্থগিত হওয়া জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার বিষয়ে তোফায়েলের সেই আশা পূরণ হয়নি।
অবশ্য জিএসপি ফিরে পেতে তোফায়েলের ওই আশাবাদ ব্যক্ত করার এক মাস আগে ২০১৫ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গিয়ে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি ফিরিয়ে দিলে দেবে, না দিলে না দেবে।
সোনারগাঁও হোটেলে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী
তিনি বলেন, ‘আমাদের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। জিএসপি কেন বন্ধ করেছে, সেটা আমরা জানি না। তারা ১৬টি শর্ত দিয়েছিল, আমরা তা পূরণ করেছি। যদিও জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশ খুব কম পেত, কাজেই এটা নিয়ে তাদের এত শর্ত দেয়া অযৌক্তিক।’
এর আগে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হওয়ার বিষয়ে ২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জিএসপি সুবিধা খুবই সামান্য। কিন্তু বাতিল হওয়াটা দেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। জিএসপি বাতিলের পেছনে কোনো পরাশক্তি নয়, ঘরের শত্রু বিভীষণের হাত রয়েছে। এ দেশেরই অপশক্তি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।
‘যিনি একসময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বিরোধী দলের নেতা ছিলেন, তিনি বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। ওয়াশিংটনের কোনো এক অখ্যাত পত্রিকায় তিনি একটি দেশবিরোধী নিবন্ধনও লিখেছিলেন’- অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, শুধু রফতানির কথা চিন্তা করলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে জিএসপি আমাদের জন্য তেমন কিছু নয়। তবে এর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং জড়িত। আমরা এখন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করছি, এখানে তৈরি পোশেকের বাইরে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন হবে। সেগুলোতে জিএসপি সুবিধা পেলে আমরা অনেক শুল্কমুক্ত সুবিধা ইউএস’র বাজারে পেতে পারি। সুতরাং বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং, ভবিষ্যত রফতানি, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে জিএসপি গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, জিএসপি ফিরে পেতে আমাদের আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত। সেইসঙ্গে তাদের ১৬টি শর্তের বিপরীতে আমরা কী কী করেছি তা দেখা উচিত এবং তাদের যদি কোনো বিষয়ে অবজারভেশন থাকে সেগুলো পূরণ করার দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, জিএসপি নিয়ে অতীতে কী হয়েছে সেই প্রসঙ্গ না টেনে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে। জিএসপি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ভবিষ্যতে যাতে মার্কিন বাজারে তৈরি পোশাকের বাইরে রফতানি বাড়াতে এটি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এ বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি টিকফাতেও আমাদের এ প্রসঙ্গ তোলা উচিত।
২০১৩ সালে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত হলেও এ পদক্ষেপের জন্য ২০০৭ সালে দাবি জানায় আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশন (এএফএল-সিআইও)। তখন থেকেই শ্রমিকের স্বার্থ সুরক্ষা ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তাজনিত শর্ত পূরণে ব্যর্থতার কারণ দেখিয়ে সংগঠনটি বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের দাবি করে।
এরপর জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি রন কার্ক ২০১১ সালের ২১ ডিসেম্বর তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদেরকে চিঠি লেখেন। চিঠিতে রন কার্ক বলেন, বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা বাতিলের আবেদনপত্রে বলা আছে, ‘এ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সব শর্ত বাংলাদেশ পূরণ করছে না। বিশেষ করে, শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এসব ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশ সরকারের কাছে উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছিল’।
ওই চিঠিতে রন কার্ক বলেন, ‘শিগগিরই মার্কিন সরকার নিয়মানুযায়ী ফেডারেল রেজিস্ট্রারে (সরকারের গেজেট) নোটিস জারি করবে। সেখানে ঘোষণা থাকবে, শ্রমিক অধিকারের বিষয়েই তারা বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল বা স্থগিত করার কথা বিবেচনা করছে। এ জন্য গণমতামত চাওয়া হবে। এরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন।’
রন কার্কের ওই চিঠির পর ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে। তার আগে পোশাক কারখানায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা, অবনতিশীল শ্রম পরিস্থিতি ও শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড এবং তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ফলে রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে এবং ওবামা প্রশাসন বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে।
এ বিষয়ে মার্কিন বাণিজ্যবিষয়ক প্রতিনিধি মাইকেল ফ্রোম্যান ২০১৩ সালের ২৭ জুন ওয়াশিংটনে এক বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট (সাবেক) বারাক ওবামার এক আদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা স্থগিত করা হলো। সাম্প্রতিক কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনায় ফুটে উঠেছে যে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে কাজের নিরাপত্তা ও শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে গুরুতর ত্রুটি রয়েছে।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র
জিএসপি সুবিধা স্থগিত প্রসঙ্গে সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার ওই আদেশে বলা হয়, ‘আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে... উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পাওয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিত করাই শ্রেয়। কারণ, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক অধিকারের মানদণ্ড অনুযায়ী তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কিংবা নিচ্ছে না।’
জিএসপি সুবিধা স্থগিতের পেছনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাত থাকার অভিযোগ ওঠায় ২০১৩ সালের ২৯ জুন (জিএসপি সুবিধা স্থগিত হওয়ার দুদিন পর) জাতীয় সংসদে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিএসপি ফিরিয়ে দিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি অনুরোধ করেছেন।
জিএসপি বাতিলের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকায় নিবন্ধন লেখার বিষয়টি অস্বীকার করে খালেদা জিয়া বলেন, জিএসপি সুবিধা বাতিল করার অনুরোধ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি কখনও চিঠি পাঠাননি। এটা আমার নয়। এমন কোনো লেখা আমি পাঠাইনি।
খালেদা জিয়ার ওই বক্তব্যের সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় ওই লেখার একটি কপি তুলে ধরে সংসদে দেখান প্রধানমন্ত্রী। পরে সংসদে শেখ হাসিনা বলেন, ‘খালেদা জিয়া জিএসপি সুবিধা বাতিলের অনুরোধ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছেন, যা দুঃখজনক।’
এমএএস/জেডএ/এমএআর/এমকেএইচ