চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতি স্বীকার, সুযোগ নিচ্ছে দুষ্টচক্র
ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) সমন্বয়ের সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক মালিকদের চাপে নতি স্বীকার করে দফায় দফায় অতিরিক্ত এডিআর সমন্বয়ে সময় বাড়ানো হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন ভূমিকায় একটি দুষ্টচক্র শেয়ারবাজার থেকে অনৈতিক সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
তাদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য যে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হবে, কিছুতেই তা থেকে সরে আসা যাবে না। এতে সাময়িক কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ একটি সময় পর তা ঠিক হয়ে যাবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে ভালো সুফল পাওয়া যাবে। কিন্তু বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে তা সবার কাছেই ভুল বার্তা দেবে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর চলতি বছরের শুরুতেই শেয়ারবাজারে তেজিভাব দেখা দেয়। কিন্তু এডিআর ইস্যুকে কেন্দ্র করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে এসে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়া শুরু হয়। শেয়ারবাজারের এই নেতিবাচক প্রভাব গত সপ্তাহেও ছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) বাংলাদেশ ব্যাংক এডিআর সমন্বয়ের সময় ৬ মাস বাড়িয়ে দিলে রোববার শেয়ারবাজারে বড় উত্থান হয়।
এডিআরকে কেন্দ্র করে এর আগেও শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। ঋণপ্রবৃদ্ধি ব্যাপক হারে বাড়তে থাকায় গত বছরের ৩০ জানুয়ারি ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত কমিয়ে একটি নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নির্দেশনায় ৩০ জুনের মধ্যে এডিআর কমিয়ে প্রচলিত ধারার ব্যাংকের জন্য ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ইসলামী ধারার ব্যাংকের জন্য ৮৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলা হয়। যা আগে ৮৫ ও ৯০ শতাংশ ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনা জারির পর শেয়াবাজারে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে এক মাস না যেতেই ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি আরেকটি নির্দেশনা জারির মাধ্যমে এডিআর সমন্বয়ের সময় বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর করা হয়। তবে ব্যাংক মালিকদের পক্ষ থেকে এডিআর সমন্বয়ের সময় আরও বাড়ানোর জন্য দাবি জানানো হয়।
এ পরিস্থিতিতে গত বছরের ১ এপ্রিল ব্যাংক মালিকদের সংগঠন ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সঙ্গে রাজধানীর প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে গভর্নর ফজলে কবিরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দলও অংশ নেন। বৈঠকে বিএবির সদস্যরা এডিআর সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানোর দাবি জানালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়।
তবে এ দফাতেও সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমানত কমে যাওয়াসহ নানা কারণে ব্যাংকগুলো এটি বাড়ানোর দাবি করে। এরই প্রেক্ষিতে এখন নতুন করে আবারও ছয় মাস সময় বাড়িয়ে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ সমন্বয়ের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ঋণ আমানত অনুপাত উল্লিখিত হারের চেয়ে বেশি রয়েছে যে সব ব্যাংকের, সেগুলোকে ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ক্রমান্বয়ে নির্ধারিত মাত্রায় নামিয়ে আনতে হবে। এ জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে ডিপার্টমেন্ট অব অব-সাইট সুপারভিশনে দাখিল করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের বিষয়ে সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এডিআর সমন্বয়ের সীমা বার বার বাড়ানোর যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। সাড়ে ৮৩ শতাংশ করার বিষয়ে বার বার সময় বাড়ানো হচ্ছে। এটার একটা কারণ হয় তো বলবে তারল্য সঙ্কট। কিন্তু সার্বিকভাবে ব্যাংকিং সিস্টেমে কোনো তারল্য সঙ্কট নেই। কিছু কিছু ব্যাংকের আছে। কাজেই এটা (সময় বাড়ানো) কারার কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল বলে আমার মনে হয় না।
তিনি বলেন, এ সবকিছুই করা হচ্ছে চাপের মুখে। এর আগে ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও এবং রেপো রেট কমানো হয়েছে। কিন্তু তাতে তো বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়নি। তার মানে সমস্যা সরবরাহের ক্ষেত্রে না, চাহিদার ক্ষেত্রে। যেহেতু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা আছে, সে কারণে লোকে ঋণ নিতে চাচ্ছে না, বিনিয়োগ হচ্ছে না। যে কারণে মূলধনি পণ্যের আমদানি কমে গেছে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, এডিআর সমন্বয়ের সময় শেষ হয়ে আসলেই শেয়ারবাজারে একধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়, এর কোনো অর্থ নেই। এডিআর ৮৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ৮৩ শতাংশ করলে শেয়ারবাজারে তারল্য খুব একটা কমতি হবে না। শেয়ারবাজারের বড় সমস্যা সঞ্চয়পত্রের সুদ হার বেশি থাকা। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরাপদ। একদিকে ঝুঁকি নেই, অন্যদিকে সুদ হার বেশি হওয়ায় সঞ্চয়পত্রে বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, এডিআর সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বার বার সময় বৃদ্ধিকে আমি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতা হিসেবে দেখছি। কোনো নির্দেশনা বাস্তাবায়নের ক্ষেত্রে বার বার সময় বাড়ানো হলে তার কার্যকারিতা থাকে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত শক্ত অবস্থান নেয়া। তা না হলে এটা পরিপালন হবে না। বার বার সময় বাড়ানোর কারণে একটি ভুল বার্তা দেয়া হচ্ছে। সবাই ধরে নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক সময় বাড়াবেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ব্যাংক খাতের তারল্য সঙ্কটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এডিআর সমন্বয়ের সময় বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তিসংগত হোক বা না হোক, এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসির ব্যাপার। বাংলাদেশ ব্যাংক যেটা ভালো মনে করে সেটা করতেই পারে। আজ (১০ মার্চ) শেয়ারবাজারে যে কিছুটা ভালো হলো এটা এডিআর সময়ন্বয়ের কারণে হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
তিনি বলেন, ব্যাংকের এডিআর সমন্বয় করতে হলে শেয়ার বিক্রি করতে হয়। আর শেয়ার বিক্রি করলে দাম পড়ে যায়। এ জন্য যখনই এডিআর সমন্বয়ের সময় বাড়িয়ে দেয় তখন বাজারটা একটু ভালো থাকে। তবে এটা কোনো ভালো যুক্তি না। সময় না বাড়ালে হয় তো সাময়িক কিছুটা সমস্যা হতে পারে। তবে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য তা ভালো প্রভাব ফেলবে।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা জাগো নিউজকে বলেন, নির্দেশনা দিয়ে তা পেছানো খারাপ লক্ষণ। কারণ লোকজন ধরে নেয় এটা আবার পেছাবে। সুতারং এ জিনিসটা ভালো না। যদি এটা যৌক্তিক না হয়ে থাকে, তাহলে বাতিল করে দিক। অথবা এডিআরকে আরও রিলাক্স করে দিক।
তিনি বলেন, এডিআর সমন্বয় করার ডেট লাইন যখন আসে, তখন ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রেশার (চাপ) থাকে- আমরা টাকা কোথা থেকে পাব। এতে ব্যাংক ডিপোজিট (আমানত) বাড়ানোর চেষ্টা করে। ফলে তারা সুদের হার বাড়িয়ে হলেও বাজার থেকে টাকা ওঠাতে চায়। তখন শেয়ারবাজারে এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
তিনি আরও বলেন, যেটা জাস্টিফাইড তার জন্য যে ডেট লাইন আছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। শেয়ারবাজারে যা হয় হোক, এটা নিয়ে চিন্তা করার কারণ নেই। কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও তা একসময় ঠিক হয়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার বার সময় বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে আমি খুব ভালো ভাবে দেখি না। বার বার সিদ্ধান্ত পেছানোর কারণে একটি দুষ্ট চক্র সুবিধা নেয়। তারা একটি অ্যালার্মিং সিচুয়েশন করে এ কাজটা করে।
এমএএস/এমএমজেড/এমকেএইচ