ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

‘নয়-ছয়ের’ খেলায় স্বল্প সুদে ঋণ

প্রকাশিত: ১১:৪২ এএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

>> আমানতে ৬ এবং ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ
>> ৭ মাস পার হলেও এর সুফল পাননি উদ্যোক্তারা
>> ১৪-১৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য করা হচ্ছে
>> ‘ইজ অব ডুয়িং’ বিজনেসের ওপর গুরুত্বারোপ

উদ্যোক্তা সাইফুদ্দিন। গোপালগঞ্জে একটি মাছের খামার করেছেন। এখন বাণিজ্যিকভাবে খামার সম্প্রসারণ করবেন। এজন্য বাড়তি অর্থের প্রয়োজন। ১২ কোটি টাকার ঋণের আবেদন করেছেন সরকারি একটি ব্যাংকে। প্রায় পাঁচ লাখ টাকাও খরচ হয়েছে। কিন্তু ছয় মাসেও মেলেনি ঋণ। কাঙ্ক্ষিত অর্থের জোগান না পেয়ে বাণিজ্যিক খামার এখন স্বপ্নই রয়ে গেছে তার।

সাইফুদ্দিন জাগো নিউজকে জানান, দুটি মাছের প্রকল্প রয়েছে তার। নিজস্ব ও লিজ নেয়া জমিতে পুকুর খনন করে খামার করেছেন। এতে তার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। এখন বড় আকারে বাণিজ্যিকভাবে মাছের খামার করতে চান। এজন্য নিজের বিনিয়োগ ছাড়াও আরও ১২ কোটি টাকা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন >> জুলাই থেকে ঋণের সুদ ৯ শতাংশের বেশি নেবে না ব্যাংক

বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকে যোগাযোগ করেন। কিন্তু যারা ঋণ দিতে আগ্রহী তাদের ঋণের সুদহার ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। এজন্য কম সুদে ঋণের প্রত্যাশায় ব্যাংকে ২১ কোটি টাকা মূল্যের জমি জামানতের বিপরীতে ১২ কোটি টাকা ঋণ আবেদন করেন। গত বছরের জুনে আবেদনটি করা হয়। প্রকল্পের ফাইল তৈরি, প্রোসেসিং, অডিটসহ বিভিন্ন খরচ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ টাকা গেছে। কিন্তু সাত মাসেও মেলেনি ঋণ। ব্যাংকের পক্ষ থেকে এতদিন বলা হয়েছে, নির্বাচনের কারণে ঋণ পাস হচ্ছে না। এখন বলছে, রাজনৈতিক কিছু সমস্যা রয়েছে। এ কারণে বোর্ড অনুমোদন দিচ্ছে না।

ঋণপ্রত্যাশী এ উদ্যোক্তা বলেন, ব্যবসার একটি পরিকল্পনা ও বাজেট থাকে। সময় মতো বাস্তবায়ন না করতে পারলে খরচ বেড়ে যায়, অনেক সমস্যাও সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে ব্যবসা শুরুর আগে প্রতিবন্ধকতার শেষ নেই। এ অবস্থায় স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ঋণ পাওয়াই মুশকিল।

‘যারা অনিয়ম করে ঋণ চাচ্ছে তাদের ঠিকই ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে। আর আমরা চাইলে নানান টালবাহানা।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে যাচ্ছে। ফেরতও পাচ্ছে না। ব্যাংক এখন ঋণ ফেরত পেতে ওই খেলাপিদের পেছনে পেছনে ঘুরছে। অথচ আমরা সব নিয়ম মেনেও পাচ্ছি না ঋণ।’ শুধু সাইফুদ্দিন নয় এমন ভোগান্তিতে রয়েছেন হাজারও তরুণ উদ্যোক্তা।

জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর নানা শর্তের বেড়াজালে আটকে আছেন উদ্যোক্তারা। আবার অনেক ক্ষেত্রে শর্ত পূরণেও মিলছে না ঋণ। ফলে দিনের পর দিন ব্যাংকে ব্যাংকে ঘুরছে মানুষ। সময়মতো ঋণ না পেয়ে উৎপাদনমুখী কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এতে লোকসানের কবলে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে নতুন করে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। সর্বোপরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু সর্বশেষ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির হয়েছে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ঘোষিত মুদ্রানীতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম।

আরও পড়ুন >> আগ্রাসী ঋণে লাগাম টানা জরুরি

এদিকে তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে কমছে। গেল নভেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ০১ শতাংশে। যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

গত অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। যা সেপ্টেম্বরে ছিল ১৪ দশমিক ৬৭ শতাংশে। এর আগে গত আগস্ট শেষে প্রবৃদ্ধি নেমেছিল ১৪ দশমিক ৯৫ শতাংশে। আগের মাস জুলাইতে যা ছিল ১৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

এদিকে মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ফজলে কবির বলেন, অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু ডিসেম্বর শেষে দেখা যায় এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যের চেয়ে অনেক কম হয়েছে; ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সম্ভাব্য অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠার কারণে এটি হয়ে থাকতে পারে বলে জানান তিনি।

‘কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন ও কর্মসংস্থান বাড়াতে উৎপাদনশীল খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়াতে জোর দেয়া হচ্ছে’ উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, ‘এখন নির্বাচন শেষ হয়েছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বিরাজ করছে। আগামীতে ঋণের প্রবাহ বাড়বে’ বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।

এদিকে গত বছরের জুনে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ব্যাংক ঋণের সুদহার কমানোর ঘোষণা দেন ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যবস্থাপকরা। তাদের ঘোষণা অনুযায়ী ব্যাংকের আমানতে ৬ এবং ঋণে হবে ৯ শতাংশ সুদহার। গত বছরের জুলাই থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সাত মাস পার হলেও এর সুফল পাননি উদ্যোক্তারা।

নয়-ছয়ের খেলায় স্বল্প সুদে ঋণ তো পাচ্ছেই না, উল্টো ভোগান্তিতে পড়েছেন বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।

ছয়-নয়ের খেলায় ভোগান্তিতে পড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান। তিনি বলেন, ‘সুদ কমানোর নামে ব্যাংকগুলো সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু এর সুফল ব্যবসায়ীরা কিছুই পাচ্ছেন না। সুদহার তো তারা কমায়নি উল্টো ঋণে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণের জন্য শর্ত হিসেবে একটি ব্যাংক নোটিস দিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, কোনো ঋণের কিস্তি তিন বছরে একটিও যদি নির্ধারিত সময়ের পর পরিশোধ হয় তাহলে সে এ সুবিধা পাবেন না। এমন শর্ত দেয়া হয়েছে যে, যা পূরণ করে কেউ যেন সুবিধা নিতে না পারে। ব্যাংকগুলো সুদ না কমিয়ে বিভিন্ন গোপন চার্জ ও ফি আদায় করছে। এতে ব্যবসায়ীরা উপকারের বিপরীতে সময়মতো ঋণ না পেয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।’

এসব বিষয়ে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) নতুন চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সঠিক নিয়মনীতি অনুসরণ করে কেউ যদি ঋণ আবেদন করেন তাহলে অবশ্যই ঋণ পাবেন। তবে ব্যাংক কোন খাতে ঋণ দেবে- এটা তাদের ব্যবসায়কি পলিসির ওপর নির্ভয় করে।’

আরও পড়ুন >> ঋণের সুদ বেশি নিচ্ছে ৩১ ব্যাংক

‘নির্বাচন, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটসহ বিভিন্ন কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমেছে। তবে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ প্রদান শুরু হয়নি- এ কথা সঠিক নয়’ বলেও দাবি করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘সিঙ্গেল ডিজিটে অনেকে ঋণ সুবিধা পেয়েছেন। আমাদের ব্যাংকেরও অনেক গ্রহাককে দেয়া হয়েছে। তবে খেলাপিদের নয়; এ সুবিধা দেয়া হচ্ছে ভালো গ্রাহকদের।’

এদিকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দীন বলেন, ‘ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ভোগান্তি নতুন কিছু নয়। এটি নিয়ে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেছি। কিন্তু কোনো কাজে আসছে না। আমাদের দেশে ব্যবসার পরিচালন খরচ বেশি। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়া কঠিন। এত উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করার মতো কোনো ব্যবসা দেশে আছে বলে মনে হয় না। তাই সুদের হার না কমালে সরকারি খাতে ঋণ বাড়ানো সম্ভব নয়’ বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘শুধু ঋণ নয়, ব্যবসায়ীরা পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এটি কমাতে হবে। একই সঙ্গে অবকাঠামোগত সমস্যা দূরসহ ‘ইজ অব ডুয়িং’ বিজনেসে আমাদের উন্নতি করতে হবে। তা না হলে প্রবৃদ্ধি ডাবল ডিজিটে নেয়া সম্ভব নয়।’

এসআই/এমএআর/এমএস

আরও পড়ুন