ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

‘রেড’ জোনে যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান

প্রকাশিত: ০২:১৬ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

অনিয়ম-দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় নাজুক দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই)। এ খাতের ১২ প্রতিষ্ঠান এখন সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে অর্থাৎ ‘রেড জোনে’অবস্থান করছে। চাপ সহনশীল (স্ট্রেস টেস্টিং) প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ জোনে ফেলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তালিকায় ‘রেড জোনে’ থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ফাস্ট লিজ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, রিলায়েন্স ফিন্যান্স, ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি, প্রাইম ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স, ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, এফএএস ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল এবং বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা জানার জন্য কয়েকটি সূচকের ওপর বিশেষ পদ্ধতিতে নিরীক্ষা চালায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদহার বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকি, ঋণঝুঁকি, সম্পত্তির (ইকুইটি) মূল্যজনিত ঝুঁকি ও তারল্য অভিঘাত- এ চার ঝুঁকি বিবেচনায় নেয়া হয়। নিরীক্ষার ভিত্তিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। ভালোগুলোকে ‘গ্রিন’ জোন, ভালোর চেয়ে একটু খারাপ অবস্থায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো ‘ইয়েলো’ জোনে এবং চরম খারাপ অবস্থায় থাকাগুলোকে ‘রেড’ জোনে ভাগ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

২০১৮ সালের সর্বশেষ সেপ্টেম্বরের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকির বিচারে ‘গ্রিন’ জোনে রয়েছে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান। ‘ইয়েলো’ জোনে রয়েছে ১৮টি প্রতিষ্ঠান। ‘রেড’ জোনে অর্থাৎ উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে ১২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, ঋণ বিতরণে অব্যবস্থাপনা, সম্পত্তির ঝুঁকি ও তারল্য সংকটে দুরাবস্থায় রয়েছে ‘রেড’ জোনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো। ঋণ বিতরণে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না এসব প্রতিষ্ঠান। অনেকে আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণ করেছে বেশি। ক্যাশ ফ্লো বা পরিচালন নগদ প্রবাহও ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। ফলে আমানতের টাকা সময়মতো গ্রাহককে ফেরতও দিতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কয়েকটি খারাপ অবস্থায় রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করছে। তবে আমানতের অর্থ ফেরত দিচ্ছে না- এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’

এছাড়া ‘রেড’ জোনে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিবিড়ভাবে তদারকি করেছে বলেও জানান ডেপুটি গভর্নর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত খেলাপি ঋণের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি প্রান্তিকেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ছিল চার হাজার ৫২০ কোটি টাকা। তিন মাসে এক হাজার ৪০ কোটি টাকা বেড়ে ২০১৮ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে হয় পাঁচ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। জুন প্রান্তিকে আরও বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৯২০ কোটি টাকায়। সেপ্টেম্বর শেষে তা ওঠে সাত হাজার ৪৯০ কোটি টাকায়, যা এ খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ২০ শতাংশ। তিন মাস আগে জুনে এ হার ছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ।

গেল বছর তিন প্রান্তিকে অর্থাৎ নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে দুই হাজার ৯৭০ কোটি টাকা বা প্রায় ৬৬ শতাংশ। এর আগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণ ছিল চার হাজার ৫২০ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানও নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে। তারা একদিকে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে, অন্যদিকে ঋণ বিতরণে কোনো যাচাই-বাছাই করছে না। ফলে ত্রুটিপূর্ণ ঋণ আর ফেরত আসছে না। এতে নগদ অর্থ সংকটে পড়ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

‘আমানতকারী টাকার নিরাপত্তার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখে। তারা যদি গ্রাহকের সেই অর্থ সঠিক সময়ে ফেরত না দেয় তাহলে তারা কোথায় যাবে? এটি খুবই ভয়ঙ্কর অবস্থা। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ আমানতকারীর সুরক্ষা দেয়া তাদের দায়িত্ব।’

পিপলস লিজিং

এদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘রেড’ জোনে থাকা অন্যতম প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির মোট আমানত রয়েছে দুই হাজার ৮৬ কোটি টাকা। দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার মতো নগদ টাকা প্রতিষ্ঠানটির নেই। বর্তমানে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে টাকা দরকার তার চেয়ে ৮৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা কম রয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির অনিরীক্ষত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে পিপলস লিজিং পরিচালন ব্যয় দেখিয়েছে ২২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আয় দেখানো হয়েছে দুই কোটি পাঁচ লাখ টাকা। ফলে শুধু এ নয় মাসে পরিচালন লোকসান হয়েছে ২০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।

এসব বিষয়ে বক্তব্যের জন্য পিপলস লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামি হুদার সঙ্গে বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন, ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে এবং সরাসরি অফিসে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে চাইলেও তার দেখা মেলেনি।

ফাস্ট লিজ ফাইন্যান্স

বিভিন্ন সংকটে থাকা ফাস্ট লিজ ফাইন্যান্স এখন লোকসানে রয়েছে। ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান দাঁড়িয়েছে ৩৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা। শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে তিন টাকা ১৬ পয়সা। বছর ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) কমে দাঁড়িয়েছে সাত টাকা ৭২ পয়সা। এক বছর আগে একই সময়ে যা ছিল ১২ টাকা ৩১ পয়সা।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং

ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সর্বশেষ অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির আমানত দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৮ ৯৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি ঋণ বিতরণ করেছে তিন হাজার ৭৯৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। যেসব ঋণের অধিকাংশই ত্রুটিপূর্ণ। ফলে তা আর ফেরত আসছে না। এতে নগদ অর্থ সংকটে ভুগছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নগদ টাকার সংকট তীব্র হওয়ায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ক্যাশ ফ্লো বা পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। তৃতীয় প্রান্তিক সেপ্টেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি নগদ কার্যকর অর্থপ্রবাহ (এনওসিএফপিএস) মাইনাস তিন টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।

ফারইস্ট ফিন্যান্স

২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে ফারইস্ট ফিন্যান্সের শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে এক টাকা ৩০ পয়সা। নয় মাসে শেয়ারপ্রতি প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ টাকা ৭ পয়সা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য ছিল ছয় টাকা ৩৭ পয়সা।

বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট

২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ২১ পয়সা। নয় মাসে শেয়ারপ্রতি প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ টাকা ৯৩ পয়সায়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য ছিল ১৮ টাকা ৯৯ পয়সা।

বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স

বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্সের ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে শেয়ারপ্রতি প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) মাইনাস ৭১ টাকা ৯৩ পয়সা। শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে পাঁচ টাকা ৫৩ পয়সা। শেয়ারপ্রতি সমন্বিত নগদ কার্যকর অর্থপ্রবাহ (এনওসিএফপিএস) দুই টাকা ৭২ পয়সা ঋণাত্মক রয়েছে।

প্রাইম ফিন্যান্স

প্রাইম ফিন্যান্স ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে শেয়ারপ্রতি প্রকৃত সম্পদের মূল্য (এনএভি) কমে ছয় টাকা ৮২ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। যা ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল আট টাকা ৫২ পয়সা। শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে এক টাকা ৭০ পয়সা। শেয়ারপ্রতি সমন্বিত নগদ কার্যকর অর্থপ্রবাহ (এনওসিএফপিএস) দুই টাকা ১৪ পয়সা ঋণাত্মক রয়েছে।

প্রিমিয়ার লিজিং

প্রিমিয়ার লিজিংয়ের শেয়ারপ্রতি আয় কমে দাঁড়িয়েছে চার পয়সা। নগদ অর্থ সংকটে থাকা প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ তিন টাকা ৮৭ পয়সা ঋণাত্মক রয়েছে।

ফাস ফাইন্যান্স

ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে ফাস ফাইন্যান্সের। জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০১৮ অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সমন্বিত আয় (ইপিএস) হয়েছে ০.৩৭ টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৬৩ পয়সা। এছাড়া নয় মাসে শেয়ারপ্রতি সমন্বিত নেট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো (এনওসিএফপিএস) হয়েছে পাঁচ টাকা (ঋণাত্মক)। আলোচিত সময়ে শেয়ারপ্রতি সমন্বিত সম্পদের মূল্য (এনএভিপিএস) হয়েছে ১৩ টাকা ৭১ পয়সা।

ইউনিয়ন ক্যাপিটাল

ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে সমন্বিতভাবে শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে পাঁচ পয়সা। শেয়ারপ্রতি প্রকৃত সম্পদের মূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ১৪ টাকা ২ পয়সা।

এফএএস ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট

এছাড়া এফএএস ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের সেপ্টেম্বর শেষে শেয়ারপ্রতি আয় কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭ পয়সা। এর আগের বছর একই সময়ে ছিল ৬৩ পয়সা। জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০১৮ অনিরীক্ষিত প্রতিবেদনে শেয়ারপ্রতি প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) ছিল ১৩ টাকা ৭৮ পয়সা।

এসআই/এনডিএস/এমএস

আরও পড়ুন