বাণিজ্য মেলায় ‘অবৈধ’ স্টল!
মূল লে-আউট প্ল্যানে নেই এমন অসংখ্য স্টলে ছেয়ে গেছে এবারের ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। প্রায় প্রতিটি বড় প্যাভিলিয়নের পাশের খালি জায়গায় ‘অবৈধভাবে’ খাদ্যপণ্যের এসব স্টল দেয়া হয়েছে।
মূল লে-আউট প্ল্যানে না থাকার পরও এসব স্টলের কিছু কিছু অনুমোদন দিয়েছে খোদ মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)!
মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মেলার আয়োজক ইপিবি এবং মেলামাঠের ইজারাদার প্রতিষ্ঠান মীর ব্রাদার্সের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে লে-আউট প্ল্যানবহির্ভূত এসব স্টল বসেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করছেন মেলার আয়োজক ও মেলা মাঠের ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা।
ইপিবির দেয়া লে-আউট প্ল্যান অনুযায়ী, মেলায় প্রিমিয়ার প্যাভিলিয়ন, সাধারণ প্যাভিলিয়ন, মিনি প্যাভিলিয়ন, প্রিমিয়ার স্টল, সাধারণ স্টল, খাবারের দোকানসহ মোট ৬০৫টি স্টল থাকার কথা। সেভাবেই বড়-ছোট কোম্পানিগুলোর চাহিদা অনুযায়ী মেলার স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মেলার প্রথম এক সপ্তাহ ইপিবির লে-আউট প্ল্যান অনুযায়ীই বিভিন্ন স্টল বসে।
তবে এক সপ্তাহ না যেতেই গত সোমবার (১৪ জানুয়ারি) থেকে বদলে যেতে থাকে মেলার চিত্র। লে-আউট প্ল্যানের বাইরে মেলা প্রাঙ্গণে বসতে থাকে একের পর এক স্টল। বৃহস্পতিবার (১৭ জানুয়ারি) বিকেলের মধ্যে লে-আউট প্ল্যানে না থাকা স্টলে ছেয়ে যায় পুরো মেলা প্রাঙ্গণ। এসব স্টলের মধ্যে রয়েছে- আইসক্রিম, চা-কফি, নুডলস, কোমল ও মিনারেল ওয়াটারসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য।
লে-আউট প্ল্যানে না থাকা স্টল নিয়ে যারা ব্যবসা করছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি স্টল নিতে প্রায় দেড় লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ইপিবির অনুকূলে ব্যাংকে জমা দিতে হয়েছে ৪৮ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিতে হচ্ছে দালালদের, যারা ইপিবির সঙ্গে যোগাযোগ করে মেলার মাঠে স্টল বসানোর স্থান ঠিক করে দিচ্ছেন।
মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে এসএমই ফাউন্ডেশনের স্টলের কাছে গিয়ে দেখা যায়, স্টলটিকে ঘিরে সারি সারি টং দোকানের মতো পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আছে- ম্যাগি নুডলস, অ্যাকুয়াফিনা, ইগলু আইসক্রিম, বে হিল হোটেল এবং একটি স্লিম বেল্ট ও হারবাল পণ্য বিক্রির প্রতিষ্ঠান।
স্লিম বেল্ট ও হারবাল পণ্য বিক্রির স্টলটিতে গিয়ে কথা হয় মো. সোহান নামের একজনের সঙ্গে। স্টল ভাড়া নেয়ার আগ্রহের কথা জানালে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মেলার গেটের সিকিউরিটি ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করা ফারুক হাসান ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনিই সব ঠিক করে দেবেন। আমাদের স্টলের সব ব্যবস্থা তিনিই করে দিয়েছেন।’ এ সময় ফারুক হাসানের একটি ভিজিটিং কার্ডও দেন সোহান।
ওই ভিজিটিং কার্ডে ফারুক হাসানের পদবি উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকা মহানগর (উত্তর) ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। এরপর ভিজিটিং কার্ডে থাকা মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করে স্টল নেয়ার অগ্রহ প্রকাশ করলে ফারুক হাসান বলেন, ‘মেলার মাঠে স্টল দিতে হলে সরকারের ফি বাবদ ৯০ হাজার টাকা দিতে হবে। এর বাইরে অতিরিক্ত আরও ২০-৩০ হাজার টাকা লাগবে। সব মিলিয়ে এক লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে আসেন, বাকি কাজ আমরা করে দেব। আপনি চাইলে কালকেই অনুমোদন পেপার দিয়ে দেয়া হবে।’
স্টল দেয়ার পর কেউ স্টল ভেঙে দেবে কিনা- এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘যাদের কাছে স্টল বসানোর অনুমোদন পেপার নেই, শুধু তাদের স্টলই অভিযানে ভাঙা হয়। আমরা আপনার হাতে স্টল বসানোর অনুমোদন পেপার দিয়ে দেব। এ অনুমোদন পেপার থাকলে কারও বাপের ক্ষমতা নেই আপনার স্টল ভেঙে দেয়ার। তারপরও মেলার মাঠে আপনার যত প্রকার সুযোগ-সুবিধা লাগে আমরা দেখব।’
এ সময় ব্যবসা কীভাবে করতে হবে সে পরিকল্পনাও বলে দেন ফারুক। তিনি বলেন, ‘আপনি যেহেতু কোনো কোম্পানির পক্ষ থেকে আসছেন না, তাই আপনার বরাদ্দ পেপার দেয়া হবে আপনার নামে। প্রথমে আপনি একটি কফি মেশিন এনে বসাবেন। একদিন পর হালকা-পাতলা চিপস বসাবেন। পরের দিন কিছু পানি রাখবেন। এর পরের দিন কেক, বিস্কুট উঠাবেন। এভাবে স্টল সাজাতে হবে। একদিনেই আপনি সব পণ্য উঠাতে পারবেন না।’
এরপর জাগো নিউজের পরিচয় দিয়ে ফরুক হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু স্টল বরাদ্দ নেয়া আছে, তার কিছু খালি আছে। সেগুলো ভাড়া দেয়া হচ্ছে। আমরা মেলার যেখানে খুশি সেখানে স্টল বসানোর ব্যবস্থা করছি- এমন অভিযোগ মিথ্যা।’
এ সময় এক সাংবাদিক নেতার ছোট ভাইয়ের পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকা মহানগর (উত্তর) ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে আছি। আমি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সদস্যও।’
শুধু এসএমই ফাউন্ডেশনের স্টলের পাশে নয়; বাণিজ্য মেলার সবদিকেই এভাবে লে-আউট প্ল্যানবহির্ভূত স্টল বসানো হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণে প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দিয়ে বসানো হয়েছে একটি বিশ্রামের স্থল। সেখানে দু’দিকে বসানো হয়েছে ইগলু ও অ্যাকুয়াফিনার দুটি স্টল। মেলার প্রধান গেট দিয়ে প্রবেশ করে টাওয়ারের কাছে আসলেই দেখা যাবে ফ্রিজের মধ্যে পানি ও কোমল পানি রেখে বিক্রি করা হচ্ছে।
টাওয়ারের গোড়ায় দাঁড়িয়ে পূর্বদিকে তাকালে চোখে পড়বে পোলারের আইসক্রিম এবং দক্ষিণে তাকালে দেখা যাবে ম্যাগি নুডলসের স্টল। একটু পশ্চিত দিকে স্যামসাংয়ের স্টলের কাছে দেখা যাবে ইগলু ও অ্যাকুয়াফিনার স্টল। এলজির স্টল ঘেঁসে আছে ফাস্ট ফুডের দোকান রোবো। তার দুই পাশে আছে ইগলু ও একটি স্লিম বেল্টের দোকান। সমগ্র মেলা প্রাঙ্গণেই এভাবে লে-আউট প্ল্যানবহির্ভূত অসংখ্য স্টল বসানো হয়েছে।
ইগলু আইসক্রিম বিক্রেতা মো. মান্না বলেন, ‘মেলা প্রাঙ্গণে শুধু ইগলু আইসক্রিম বিক্রির জন্য স্টল আছে ৪০টি। এর মধ্যে আমরা চারটি স্টল নিয়েছি। এসব স্টল নিতে ইপিবিকে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ এক লাখ ৯২ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। তবে স্টল বসাতে এক একটার জন্য দেড় লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। অতিরিক্ত টাকা দালালদের দিতে হয়েছে। মেলার মাঠের ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত মুকুল ভাই আমাদের বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’ এ সময় ইপিবির উপ-সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফের সই করা একটি বরাদ্দপত্র দেখান মান্নান।
তবে মেলা প্রাঙ্গণের ভেতরে স্টল বসানোর ব্যবস্থা করে দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মেলা মাঠের ইজারা পাওয়া প্রতিষ্ঠান মীর ব্রাদার্সের কর্ণধার মীর শহিদুল আলম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের কেউ মেলার মাঠে স্টল বসানোর কাজ করছে না। কেউ এমন অভিযোগ করলে তা মিথ্যা। আমরা স্টল বসানোর কোনো দায়িত্বে নেই।’
এ সময় জাগো নিউজের পক্ষ থেকে বলা হয়, মুকুল তো আপনার আত্মীয়, তার বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ উঠছে। উত্তরে শহিদুল বলেন, ‘এখানে (মেলায়) তো আমার আত্মীয় অনেক। যারা আমার কার্ডধারী ভলেন্টিয়ারের দায়িত্ব পালন করছে তারা কেউ এসবের সঙ্গে জড়িত নয়। এসব অভিযোগ মিথ্যা।’
এদিকে শনিবার দুপুরে ইপিবির উপ-পরিচালক আবু মোখলেছ আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে অবৈধ স্থাপন উচ্ছেদে অভিযান চালানো হয়। ওই অভিযানে কয়েকটি স্টল ভেঙে দেয়া হলেও লে-আউট প্ল্যানবহির্ভূত সিংহভাগ স্টল কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে।
অভিযান চালানোর সময় আবু মোখলেছ আলমগীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মেলার ভেতরে অনেক স্টল আছে যেগুলো অবৈধ। ইপিবি থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো অনুমোদন দেয়া হয়নি। তারপরও অবৈধভাবে তারা ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাচ্ছে। এজন্য এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। যাদের কাছে ইপিবির অনুমোদনপত্র আছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।’
লে-আউট প্ল্যানে না থাকার পরও বেশকিছু স্টল ইপিবি থেকে অনুমোদন নিয়ে মেলার ভেতরে ব্যবসা করছে। এগুলোর বিরুদ্ধে আপনার কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আইসক্রিমের কিছু স্টল মেলার যে সচিবালয় আছে সেখান থেকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যেটা প্রথমে লে-আউট প্ল্যানে ছিল না, কিন্তু পরবর্তীতে দেয়া হয়েছে। এগুলোর বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। তবে কিছু কিছু বিধি মোতাবেক দেয়া হয়েছে। আর কিছু অবৈধভাবে আছে। অবৈধভাবে থাকাগুলোর বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ইপিবির উপ-সচিব ও মেলার সদস্য সচিব মোহাম্মদ আব্দুর রউফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘মেলার ভেতরে যারা অবৈধভাবে স্টল বসিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান শুরু হয়েছে। অবৈধ কোনো স্টল আমরা মেলার মাঠে থাকতে দেব না। তবে নুডলস, আইসক্রিম ও চা-কফির কিছু স্টল বসানোর অনুমোদন আমরা দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে আমার সই করা বরাদ্দপত্র আছে, সেগুলো বৈধ। কিন্তু আমাদের বরাদ্দপত্রের সুযোগ নিয়ে অনেকে অতিরিক্ত স্টল বসিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে।’
‘আর একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, ইপিবি ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে স্টল বরাদ্দ নিলে তা সম্পূর্ণ অবৈধ। ইপিবি ছাড়া মেলার মাঠে স্টল বরাদ্দ দেয়ার ক্ষমতা কারও নেই’- যোগ করেন তিনি।
এমএএস/এনডিএস/এমএআর/আরআইপি