‘টালমাটাল’ পুঁজিবাজার
>> ‘নির্বাচন আতঙ্কে নেতিবাচক প্রভাব’ যুক্তিসংগত নয়
>> বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকটই মূল সমস্যা
>> প্রায় তিন মাস ধরে নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই
বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকটে টালমাটাল দেশের পুঁজিবাজার। ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-এর মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগের ঘোষণাও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে পারছে না। ফলে প্রায়সই ঘটছে বড় দরপতন। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে লেনদেন খরা।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে এখন মূল সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট। তবে বাজারে যে অবস্থা বিরাজ করছে তা অস্বাভাবিক। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বাজারে এমন অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করছে কিনা- তা খতিয়ে দেখা উচিত।
স্টক এক্সচেঞ্জ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন পক্ষ থেকে বাজারে যে ধরনের সাপোর্ট দেয়ার কথা ছিল তা হচ্ছে না। আইসিবি অনেকটা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বন্ড বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। কিন্তু এখনও সেই বন্ড বিক্রি করতে পারেনি।
এদিকে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ ঘুরে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চরম আস্থার সংকটে ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা। অনেকে আতঙ্কে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। বড় বিনিয়োগকারীরাও বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ করছেন না। প্রায় তিন মাসে ধরে এ অবস্থা বিরাজ করছে।
যে কারণে পুঁজিবাজারে গতি ফেরাতে আইসিবিকে দুই হাজার কোটি টাকার বন্ড ছেড়ে তার কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে বাধ্যতামূলক নির্দেশ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে এ সুসংবাদ আসার পরও পতনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি বাজার। দরপতনের মাত্র আরও বাড়ে।
এ পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহে জরুরি বৈঠকে বসে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। ওই বৈঠক শেষে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী সানাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বন্ড বিক্রির পুরো দুই হাজর কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে চাই। আগামী সপ্তাহ থেকে এ টাকা বিনিয়োগ করতে পারবো বলে আশা করছি।
তবে আইসিবির একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএসইসির অনুমোদন দেয়া বন্ড এখনও বিক্রি করতে পারেনি আইসিবি। জাগো নিউজকে একই তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক রকিবুর রহমান।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স ছিল ছয় হাজার ২৫৪ পয়েন্ট এবং বাজার মূলধন ছিল চার লাখ ২৩ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। সেখান থেকে ২৮ অক্টোবর লেনদেন শেষে ডিএসইএক্স পাঁচ হাজার ২১২ পয়েন্টে এবং বাজার মূলধন তিন লাখ ৮১ হাজার ৩০৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ চলতি বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রধান মূল্য সূচক হারিয়েছে এক হাজার ৪২ পয়েন্ট। বাজার মূলধন হারিয়েছে ৪২ হাজার ১১৮ কোটি টাকা।
ধারাবাহিক বড় দরপতনের এক কার্যদিবস পর সোমবার ডিএসই ও সিএসইর মূল্য সূচকের বড় উত্থান হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে লেনদেনের পরিমাণ।
পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকটের কারণে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। তবে তাদের এই আস্থাহীনতার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।’
তিনি বলেন, ‘অনেক ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম এখন বেশ কম। আবার সামষ্টিক অর্থনীতিও বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ভালো হচ্ছে, রেমিট্যান্সও (প্রবাসী আয়) ভালো আসছে। রফতানির প্রবৃদ্ধিও ভালো। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগাকারীদের শেয়ার কেনার কথা।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের সংশয় আছে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বা রাজনীতি কেন্দ্রীক কোনো সংঘাত নেই। সুতরাং নির্বাচন কেন্দ্রীক আতঙ্কের কারণে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে- এটাও যুক্তিসংগত নয়।’
অবশ্য আইসিবির ঘোষিত টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শুরু হলে পরিস্থির উন্নতি হতে পারে বলে মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই অর্থ উপদেষ্টা। তিনি আরও বলেন, ‘আইসিবির বন্ড বিক্রির টাকা এখনও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হয়নি। যদি এ টাকা বিনিয়োগ হয় তাহলে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়বে।’
বিএসইসির অপর এক চেয়ারম্যান (সাবেক) ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, নির্বাচনের খুব একটা প্রভাব আমাদের পুঁজিবাজারে নেই। সুতরাং এ বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, সে কারণে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে- এটা যুক্তিসংগত নয়।’
‘তবে যে কারণেই হোক বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। তাদের আস্থা সংকটের কারণেই বাজারে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বাজার অস্থিতিশীলের চেষ্টা করছে কিনা- সেটি খতিয়ে দেখতে হবে’- যোগ করেন এই পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ।
আইসিবির বিনিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আইসিবি তো এখনও বন্ড বিক্রি করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেনি। আগে আইসিবির টাকা আসুক। তাদের বিনিয়োগের ঘোষণা আগেই দেয়া ঠিক হয়নি। এতে বাজারে এক ধরনের ভুল বার্তা যায়।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন পক্ষ থেকে বাজারে যে ধরনের সাপোর্ট দেয়ার কথা ছিল তার কিছুই হয়নি। আইসিবি বন্ড বিক্রি করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু তারা তো এখনও বন্ড বিক্রি করেনি। এছাড়া আইসিবির দায়িত্ব পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দেয়া। কিন্তু আইসিবি তা না করে ফারমার্স ব্যাংককে মূলধন দিয়েছে। এটা তো তাদের দায়িত্ব নয়।’
বিনিয়োগকারী মসিউর রহমান বলেন, গত সপ্তাহে হাউজ থেকে বলা হয়, বাজার আরও পড়বে। গত রোববার দেখি, সত্যিই বাজার পড়েছে। বড় বিনিয়োগকারীরা নীরব রয়েছেন। আতঙ্কে আমিও কিছু শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছি। শুধু আমি একা নই, সব ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী এখন আতঙ্কে রয়েছেন।
এমএএস/এমএআর/জেআইএম