চলছে অবৈধ ব্যয়, ভাঙতে হচ্ছে বিনিয়োগ-সম্পদ
>> ২০১৭ সালে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা
>> ২০১৫ সালের পর থেকে লাইফ ফান্ড ধারাবাহিকভাবে কমেছে
>> ২০১৩ সালের পর থেকে কমেছে বিনিয়োগ থেকে আয়
>> নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি
বছরের পর বছর ধরে আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভবে বীমাগ্রাহক (পলিসিহোল্ডার) ও শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ খরচ করছে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। ফলে দুর্বল হয়ে পড়ছে কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা। খরচ মেটাতে ভাঙতে হচ্ছে বিনিয়োগ ও সম্পদ। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে লাইফ ফান্ডে। ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে বীমা কোম্পানিটি থেকে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত পাওয়া।
জাগো নিউজের কাছে জীবন বীমা কোম্পানিটির পাঁচ বছরের অবৈধ ব্যয়, সম্পদ, বিনিয়োগ ও লাইফ ফান্ডের তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ বছরে (২০১৭ সালে) আইন লঙ্ঘন করে পদ্মা ইসলামী লাইফ ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ নয় কোটি ২৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ করেছে। এর আগের চার বছরে এ খাতে অবৈধভাবে ব্যয় করা হয় ৯৫ কোটি ৩৮ লাখ ২০ হাজার টাকা।
পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ অবৈধভাবে ব্যয়ের কারণে কোম্পানিটির ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখতে ২০১৫ সালে নিরীক্ষক নিয়োগ দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। সে সময় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস’র নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বীমা কোম্পানিটির ব্যাপক অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। তবে অদৃশ্য কারণে পদ্মা লাইফের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি আইডিআরএ।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন ভূমিকায় কোম্পানিটির অবৈধ ব্যয় তো কমেইনি বরং সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছর ২০১৭ সালে আরও বেড়েছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আইন অনুযায়ী ২০১৭ সালে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ কোম্পানিটির সর্বোচ্চ খরচের সীমা ছিল ৪৭ কোটি ৯৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি খরচ করেছে ৫৭ কোটি ২১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে নয় কোটি ২৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
২০১৬ সালে ব্যবস্থাপনা খাতে কোম্পানিটির অবৈধ ব্যয়ের পরিমাণ ছিল পাঁচ কোটি ৮৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে ২৫ কোটি ১১ লাখ ২০ হাজার টাকা, ২০১৪ সালে ৩১ কোটি ৫১ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং ২০১৩ সালে ৩২ কোটি ৯০ লাখ ৩০ হাজার টাকা ব্যবস্থাপনা খাতে অবৈধ ব্যয় করে পদ্মা লাইফ।
অর্থাৎ, কোম্পানিটিতে নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়ার পর এক বছরের ব্যবধানে ২০১৬ সালে অবৈধ ব্যয়ের পরিমাণ কমে প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগে নেমে আসে। কিন্তু নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় অবৈধ ব্যয়ের পরিমাণ আবারও বেড়েছে।
এদিকে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে পদ্মা ইসলামী লাইফের বিনিয়োগ ছিল ১৯২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। যা ২০১৪ সাল শেষে দাঁড়ায় ১৮১ কোটি ৬২ লাখ টাকায়। ২০১৫ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ১৪৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা এবং ২০১৬ সালে ১১৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ২০১৭ সাল শেষে তা আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৭৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে কোম্পানিটির বিনিয়োগ কমেছে বা ভাঙা হচ্ছে।
বিনিয়োগ ভাঙার কারণে প্রতিষ্ঠানটির ইনভেস্টমেন্ট রিটার্ন বা বিনিয়োগ থেকে আয় কমে গেছে। ২০১৭ সালে বিনিয়োগ থেকে আয় হয়েছে সাত কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা ২০১৬ সালে ছিল ১০ কোটি চার লাখ টাকা। এর আগের বছর ২০১৫ সালে বিনিয়োগ থেকে আয় হয় ১৬ কোটি ৬৯ লাখ, ২০১৪ সালে ২২ কোটি নয় লাখ এবং ২০১৩ সালে ২৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০১৩ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ থেকে আয় কমেছে।
বিনিয়োগের পাশাপাশি কোম্পানিটির সম্পদ ও লাইফ ফান্ডেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০১৭ সাল শেষে কোম্পানিটির সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, যা ২০১৬ সালে ছিল ৩৩১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ২০১৫ সালে ছিল ৩৬৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা এবং ২০১৬ সালে ছিল ৩৬৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে ২০১৪ সালের পর থেকে কোম্পানিটির সম্পদ ধারাবাহিকভাবে কমেছে।
অপরদিকে, লাইফ ফান্ডের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সাল শেষে পদ্মা ইসলামী লাইফের লাইফ ফান্ড দাঁড়িয়েছে ১২৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা, যা ২০১৬ সালে ছিল ২৭৩ কোটি তিন লাখ টাকা। এর আগের বছর ২০১৫ সালে ৪১৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা, ২০১৪ সালে ৩১৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং ২০১৩ সালে ৩০০ কোটি ৪৪ লাখ টাকার লাইফ ফান্ড ছিল। এ হিসাবে ২০১৫ সালের পর থেকে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ধারাবাহিকভাবে কমেছে।
কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড, সম্পদ ও বিনিয়োগ কমার চিত্র দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে একটি জীবন বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, লাইফ ফান্ড হলো জীবন বীমা কোম্পানির প্রাণ। কিন্তু পদ্মা লাইফের এই লাইফ ফান্ডেই টান পড়েছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। এছাড়া কোম্পানিটির সম্পদ ও বিনিয়োগ যে হারে কমছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে কোম্পানিটি থেকে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
যোগাযোগ করা হলে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সদস্য গোকুল চাঁদ দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘পদ্মা ইসলামী লাইফের আর্থিক অবস্থার চিত্র এখন আমার কাছে নেই। তাৎক্ষণিক একটি কোম্পানির আর্থিক অবস্থা দেখাও সম্ভব নয়। তবে পদ্মা ইসলামী লাইফ কোনো অনিয়ম করলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
২০১৫ সালে পদ্মা ইসলামী লাইফে নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়া এবং নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে গোকুল চাঁদ দাস বলেন, “শেফাক আহমেদ আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় নিরীক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। জানতে হলে শেফাক আহমেদকেই প্রশ্ন করেন।”
পদ্মা ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যান এফ এম ওবায়দুর রহমান এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা ভালো হচ্ছে না। আবার অনেক পলিসির মেয়াদ ১০-১৫ বছর হয়ে গেছে। ফলে অনেক বীমা দাবির টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। এ জন্য কিছু এফডিআর ভাঙতে হয়েছে। তবে আমাদের যে স্থায়ী সম্পদ আছে, তা কমেনি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ স্থায়ী সম্পদ আছে। এগুলো বিক্রি করতে পারলে আরও গ্রাহকের বীমা দাবির টাকা পরিশোধ করতে পারতাম। স্থায়ী সম্পদ বিক্রি করতে হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু এখন জমিজমার দাম কম। সুতরাং আমরা যে দামে কিনেছি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিশ্চয়ই তার থেকে কম দামে বিক্রির অনুমোদন দেবে না।’
এমএএস/এমএআর/পিআর