ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

অর্থনীতি নয়, দৃষ্টি নির্বাচনে

মামুন আব্দুল্লাহ , মেসবাহুল হক | প্রকাশিত: ০৯:৪০ পিএম, ০৭ জুন ২০১৮

‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ’ স্লোগানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। এর মাধ্যমে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু এ অর্থ সংগ্রহে বাড়েনি করের আওতা ও করহার। ভ্যাটেও দেয়া হয়েছে কিছুটা স্বস্তি।

বাজেট বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বাজেটে একাধারে সবাইকে খুশি করার চেষ্টা করা হয়েছে। তেমন কোনো চমক নেই। বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের। ছাড় দেয়া হয়েছে কর্পোরেট কর হারে। একইসঙ্গে, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর ব্যাপ্তি ও ভাতা বাড়ানো হয়েছে। জনতুষ্টির এই বাজেটে ক্ষমতাশীল দলের জন্য ভোট বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির জন্য এ বাজেট এক ধরনের ব্যাধির মতো। উন্নয়নশীলের দিকে দেশের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, ভোটার তুষ্টির কারণে সে যাত্রার গতি কমিয়ে দেয়া হলো।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এই বাজেটের আকার চলতি বাজেটের চেয়ে মাত্র ৬৮ হাজার কোটি টাকা বেশি। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এ বাজেট অর্থায়নে ঘাটতি রয়ে গেছে ১ লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা।

মুহিতের প্রস্তাবিত বাজেটে, ব্যাংক খাতের কর্পোরেট করহার ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংক খাতের কর্পোরেট করহার ৪০ শতাংশ। কর্পোরেট করের মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে সবচেয়ে বড় এবং বেশি কর আহরণ হয়।

ব্যাংক ছাড়া অন্য যেসব খাত থেকে কর্পোরেট কর আদায় করা হয় সেগুলো হলো- মোবাইল এবং সিগারেট কোম্পানি থেকে ৪৫ শতাংশ, লিজিং ও মার্চেন্ট ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাড়ে ৩৭ শতাংশ, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয়- এমন কোম্পানি ৩৫ শতাংশ এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য ২৫ শতাংশ হারে করহার নির্ধারিত আছে। প্রস্তাবিত বাজেটে শুধু ব্যাংক খাতের কর্পোরেট হার কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বাকি অন্যসব খাতের করহার আগের মতো অপরিবর্তিত থাকছে।

মোটামুটিভাবে বর্তমান সর্বোচ্চ করহার হবে বাস্তবে ৪০ শতাংশ এবং দ্বিতীয় হারটি হবে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলসহ সবপ্রকার তামাকজাত পণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি ও নন-পাবলিকলি ট্রেডেড মোবাইল ফোন অপারেটরে ৪৫ শতাংশ করহার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিষয়টা এমন- কর্পোরেট কর থেকে ১০০ টাকা আদায় হলে ৬৫ টাকা আসে ব্যাংক খাত থেকে। অবশিষ্ট ৩৫ টাকা অন্যসব কোম্পানি থেকে। বর্তমানে এনবিআরের অধীনে ৬০টি ব্যাংক নিবন্ধিত।

এই প্রস্তাবিত ‘বাজেটে নতুন কোনো চমক নেই’ মন্তব্য করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর্পোরেট কর কমানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষেরই বেশি লাভ হবে। কেন এ কর কমানো হয়েছে, তার পেছনে যৌক্তিক ও প্রশাসনিক কোনো কারণ দেখছি না। ব্যাংকিং খাতে নৈরাজ্যের মধ্যে এ ধরনের কর্পোরেট কর ছাড় দেয়া ঠিক হয়নি।

রোহিঙ্গাদের জন্য কী পরিমাণ অর্থ খরচ হচ্ছে? সেরকম কোনো আর্থিক মূল্যায়ন করা হয়নি- উল্লেখ করে তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রের ওপর চাপ কমিয়ে ব্যাংকিং খাতকে চাঙা করা উচিত ছিল। কিন্তু এই ঘোষিত বাজেটকে দেখে মনে হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকতে হবে। সিপিডির দীর্ঘদিনের দাবি ছিল চাল আমদানির ওপর শুল্ক বসানো, এবার এটা বাজেটে কমানো হয়েছে। সিপিডি খুশি হয়েছে। কৃষক এটাতে লাভবান হবে।

যদিও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) জানিয়েছে ভিন্ন কথা। তারা বলছে, প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার উদ্যোগে ঘাটতি রয়েছে। তবে যেহেতু চূড়ান্ত বাজেট প্রণয়নে এখনো সময় রয়েছে, তাই এটি সামগ্রিকভাবে ব্যবসাবান্ধব হবে বলে আশা রাখছে এফবিসিসিআই।

রাজধানীর মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে বাজেট পরবর্তী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার উদ্যোগে ঘাটতি রয়েছে। তবে যেহেতু চূড়ান্ত বাজেট প্রণয়নে এখনো সময় রয়েছে তাই এটি সামগ্রিকভাবে ব্যবসাবান্ধব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাজেটে ব্যাংক রেট কমানোর প্রস্তাবকে ভালো উদ্যোগ উল্লেখ করে মহিউদ্দিন বলেন, দেশের ব্যাংকিংখাতে মানুষের আস্থা ধরে রাখতে এই উদ্যোগ ইতিবাচক। সেই সঙ্গে ব্যাংকিংখাতে কমিশন গঠনের প্রস্তাবকেও ইতিবাচক হিসেবে দেখছে এফবিসিসিআই।

প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) উৎস হতে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা (জিডিপির ১১ দশমিক ৭ শতাংশ) সংগ্রহ করা হবে। এনবিআরবহির্ভূত সূত্র হতে কর রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা (জিডিপি’র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ)। এ ছাড়া, করবহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আহরিত হবে ৩৩ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা (জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশ)।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেন, রাজস্ব আদায়ের এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত। কারণ, ইতোমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জনবল ও কর্মপদ্ধতিতে ব্যাপক সংস্কার সাধন করা হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক অবস্থানে রয়েছে। কর পরিপালনের প্রবণতা দেশে বর্তমানে বেশ উচ্চমানের এবং এ প্রবণতা অব্যাহত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করার মাধ্যমে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে।

তবে বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ বাজেট বাস্তবায়নে প্রশাসনিক দক্ষতা, দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন এবং যুবশক্তির কর্মসংস্থান হবে বড় চ্যালেঞ্জ। বাজেট ঘোষণা দিলেই তো হবে না, তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, যে বাজেট দেয়া হচ্ছে, এর বাস্তাবয়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটি সব সময় বলে আসছি। প্রতিবার এমন বাড়তি বা বড় আকারের বাজেট দেয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে তা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। এবারও তাই হবে বলে মনে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত চ্যালেঞ্জ হলো- বাজেট লক্ষ্যমাত্রার জন্য প্রশাসনিক যে দক্ষতা প্রয়োজন তা আমাদের নেই। যেখানে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির অভাব রয়েছে।

তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী তথাকথিত সামাজিক সমতা এবং বৈষম্যমুক্ত হওয়ার কথা বলেছেন। তার সরকারের আমলে এ বিষয়ে সবগুলো স্তরে বৈষম্য বেড়েছে। যদিও সরকার দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যক্রম অব্যাহত রাখছে। তবে এ খাতে যে হারে বরাদ্দ ও বাস্তাবয়ন হওয়া দরকার তা হচ্ছে না। তাই এটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। একইভাবে শিক্ষিত ও যুব শক্তিদের যে কর্মসংস্থান প্রয়োজন তা কাঙ্ক্ষিত হচ্ছে না। সেজন্য দেশের ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ কর্মসংস্থান বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো খাতে উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের দক্ষতার অভাবের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেন, বাজেটে সবাইকে খুশি করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেটা দেশের অর্থনীতির জন্য কতটা সহায়ক হবে, সেটা নির্ভর করবে সংস্কারের ওপর।

প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা ও ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেটে অস্বচ্ছল, যুদ্ধাহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা অথবা নাতি-নাতনিদের সহায়তা দেবার জন্য একটি ব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রস্তুত করছে। এজন্য আগামী বাজেটে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ৩৫ লাখ থেকে ৪০ লাখে বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়। বিধবা ও স্বামী কর্তৃক নিগৃহীত মহিলা ভাতাভোগীর সংখ্যা ১২ লাখ ৬৫ হাজার থেকে ১৪ লাখে বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সম্মানী ভাতা ও উৎসব ভাতার পাশাপাশি বার্ষিক দুই হাজার টাকা হারে বাংলা নববর্ষ ভাতা চালুকরণ, জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিজয় দিবস উপলক্ষে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে বিশেষ সম্মানীভাতা চালুকরণের প্রস্তাবও এবার এসেছে।

অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা ৮ লাখ ২৫ হাজার হতে ১০ লাখে বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তির হার বাড়িয়ে প্রাথমিক স্তরে ৫০০ টাকা হতে ৭০০ টাকায়, মাধ্যমিক স্তরে ৬০০ টাকা হতে ৭৫০ টাকায় এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৭০০ টাকা হতে ৮৫০ টাকায় বৃদ্ধি এবং ভাতাভোগীর সংখ্যা ৮০ হাজার হতে ৯০ হাজার জনে বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন মুহিত।

হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উপবৃত্তির হার প্রাথমিক স্তরে ৩০০ টাকা হতে ৭০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৪৫০ টাকা হতে ৮০০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৬০০ টাকা হতে এক হাজার টাকা এবং উচ্চতর স্তরে এক হাজার হতে এক হাজার ২০০ টাকায় বৃদ্ধি; বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উপকারভোগীর সংখ্যা ৩৬ হাজার থেকে ৬৪ হাজারে উন্নীত এবং তাদের মধ্যে বিশেষ ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৩ হাজার হতে ৪০ হাজারে এবং শিক্ষা উপবৃত্তির সংখ্যা ১১ হাজার হতে ১৯ হাজারে উন্নীত করার কথা জানান অর্থমন্ত্রী।

ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড ও জন্মগত হৃদরোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজারে বৃদ্ধি, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা ৩০ হাজার হতে ৪০ হাজারে বৃদ্ধি, দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা মাসিক ৫০০ টাকা হতে ৮০০ টাকায় বৃদ্ধি এবং ভাতার মেয়াদ দুই বছরের স্থলে তিন বছর নির্ধারণ। পাশাপাশি ভাতাভোগীর সংখ্যা ছয় লাখ হতে সাত লাখে বৃদ্ধি, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তার আওতায় মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা হতে ৮০০ টাকায় বৃদ্ধি এবং ভাতা প্রদানের মেয়াদ দুই বছরের স্থলে তিন বছর নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি ভাতাভোগীর সংখ্যা ২ লাখ হতে ২ লাখ ৫০ হাজারে বৃদ্ধি করা হবে বলেও জানান মন্ত্রী।

‘কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার প্রতিটিতে ২০ হাজার হিসেবে মোট ৪০ হাজার বৃদ্ধি করে ভিজিডি কার্যক্রমে উপকারভোগীর সংখ্যা ১০ লাখ ৪০ হাজারে বৃদ্ধি করার চিন্তা রয়েছে’। একই সঙ্গে নারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বাজেটে আলাদা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণের জন্য আলাদা বিশেষ বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, নির্বাচনের বছরে এরকম বাজেটই কাম্য। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে শুল্কহার কমানো হয়েছে, এটি অনেক ইতিবাচক দিক। তবে বিনোয়োগের ক্ষেত্রে আর একটু ছাড় দিলে ভালো হতো। সব মিলিয়ে এটি একটি ভারসাম্যমূলক বাজেট।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জেন্ডার বৈষম্যের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতির কথা উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, জেন্ডার বৈষম্য একটি বৈশ্বিক বিষয়। শুধু বাংলাদেশের প্রসঙ্গ বলে লাভ নেই। সারা বিশ্বেই এখন নারী নেতৃত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে জেন্ডার বৈষম্য কমে আসছে।

ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য তেমন কিছু নেই। কিন্তু এ বিষয়টা রাখা জরুরি ছিল। নারীদের স্বাবলম্বী করতে তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করতে পারেন। তবে বাজেটে ‘ডে কেয়ার’ রাখার বিষয়টি বেশ প্রশংসনীয়।

এবারের বাজেটে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এটি অর্জন সম্ভব কি না এমন প্রশ্নের জবাবে নাজনীন বলেন, নির্বাচনের বছরে এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করা কঠিন। কারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের অনেক ব্যয় বেড়ে যাবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু পণ্যের দাম বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। আর শুল্ক ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিউটি কমানোর ফলে অনেক পণ্যের দাম কমে যাবে।

এর মধ্যে দেশীয় মোটরসাইকেল উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে। এতে দাম না কমলেও আগের দামেই মোটরসাইকেল কেনা যাবে। শর্তসাপেক্ষে ১৫০ টাকা পর্যন্ত প্লাস্টিক ও রাবারের তৈরি হাওয়াই চপ্পল ও পাদুকার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এতে এ জাতীয় পণ্যের দাম কমবে। কৃষিকাজে ব্যবহৃত বীজ আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ফলে চাষাবাদে ব্যবহৃত বীজের দাম কমতে পারে। পরিবেশ দূষণ এবং জ্বালানি ব্যয় কমিয়ে আনার জন্য হাইব্রিড গাড়ির আমদানি উৎসাহিত করার জন্য ১৮শ সিসি পর্যন্ত হাইব্রিড মোটগাড়ি আমদানি সম্পূরক শুল্ক ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হচ্ছে। কিডনি রোগের প্রতিষেধক আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এতে কিডনি রোগীরা কিছুটা কম দামে হলেও ওষুধ কিনতে পারবেন।

দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষেরা প্রতিকেজি ১০০ টাকা মূল্যমান পর্যন্ত পাউরুটি ও বনরুটি, হাতে তৈরি বিস্কুট ও হাতে তৈরি কেক (পার্টিকেক ব্যতীত) খেয়ে থাকেন। তাই প্রতিকেজি ১০০ টাকা মূল্যমান পর্যন্ত পাউরুটি, বনরুটি, হাতে তৈরি বিস্কুট এবং ১৫০ টাকা পর্যন্ত হাতে তৈরি কেকের (পার্টিকেক ব্যতীত) উৎপাদন পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি সুবিধা প্রদান করার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী।

কৃষি জমির রেজিস্ট্রেশন ফি কমানো হয়েছে। এর বাইরে কমছে রড, সিমেন্ট, বল পয়েন্ট কলম, ক্যানসারের ওষুধ, টায়ার-টিউব তৈরির কাচামাল, কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ, ডে কেয়ার হোম সার্ভিস, আমদানি পল্ট্রি খাদ্য, দেশীয় রেফ্রিজারেটরের কমপ্রেসার, গুঁড়ো দুধ। তবে এতে খুব খুশি হওয়ার কিছু নেই। বেশ কিছু পণ্যের দাম বাড়বে।

প্রস্তাবিত বাজেটের আমদানিকৃত চালের ওপর রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর ফলে সবল প্রকার চাল আমদানিতে শুল্ক ২৫ শতাংশ ও রেগুলেটরি শুল্ক ৩ শতাংশ প্রয়োজ্য হবে।
আগামী অর্থবছর থেকে ছোট ফ্ল্যাট (১ থেকে ১১০০ বর্গফুট) কেনায় খরচ বাড়তে পারে। আর মাঝারি (১১০১ থেকে ১৬০০ বর্গফুট) ফ্ল্যাট কেনার খরচ কমতে পারে।

ফ্ল্যাট কেনার পর ঘর সাজানোর আসবাবপত্র কিনতে গেলে নতুন অর্থবছরে বাড়তি চাপে পড়তে হতে পারে ক্রেতাদের। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে আসবাবপত্র উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে ১ শতাংশ করে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বর্তমানে আসবাবপত্র উৎপাদন পর্যায়ে ৬ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়।

বর্তমানে নিজস্ব ব্র্যান্ড সংবলিত তৈরি পোশাক বিক্রিতে ৪ শতাংশ হারে ভ্যাট আছে। সরকার আগামী অর্থবছর থেকে এ খাতে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য ব্র্যান্ডবিহীন পোশাক পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রেও ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ হবে।

এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবার ওপর বর্তমানে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে ভ্যাট হার ৫ শতাংশ প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে এ খাতে ব্যয় বাড়বে। সম্প্রতি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তি সেবা গ্রহণের মাত্রা বেড়েছে।

বর্তমানে ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে পণ্য বা সেবা কেনাবেচা অনেক বেড়েছে। এভাবে পণ্য ও সেবার পরিসর আরও বাড়াতে ‘ভার্চুয়াল বিজনেস’ নামে একটি সংজ্ঞা দেয়া হযেছে বাজেটে। অনলাইনভিত্তিক যে কোনো পণ্য ও সেবার ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তর এ সেবার আওতাভুক্ত হবে। এই ভার্চুয়াল বিজনেস সেবার ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে।

আসছে বাজেটে বিভিন্ন পণ্যের ট্যারিফ ভ্যালু যৌক্তিকীকরণের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে। এ তালিকায় রয়েছে- টমেটো পেস্ট, কেচাপ, সস, বিভিন্ন ফলের পাল্প, ফলের জুস, ব্যবহার অযোগ্য ট্রান্সফর্মার অয়েল, লুবব্লেন্ডিং অয়েল, বিভিন্ন ধরনের পেপার ও পেপার প্রোডাক্ট, কটন ইয়ার্ন বর্জ্য, ওয়েস্ট ডেনিম, স্ট্ক্র্যাপ/শিপ স্ট্ক্র্যাপ, সিআর কয়েল, জিপি শিট, সিআই শিট, রঙিন সিআই শিট, ব্লেড, চশমার ফ্রেম ও সানগ্লাস।

এছাড়া আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম ভ্যাট ও ব্যবসায়ী পর্যায়ের ভ্যাট ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। আমদানিতে এর প্রভাব পড়তে পারে। বর্তমানে প্রায় ১১০০ ধরনের পণ্য আমদানি হয়, যেখানে ভ্যাট দিতে হয়।

এর বাইরে এনার্জি ড্রিংক, প্রসাধনসামগ্রী, সানস্ক্রিন সানগ্লাস, আফটার শেভ লোশন, সিগারেট, সিরামিক বাথটাব, ফিলামেন ল্যাম্প, পলিথিন, লিপস্টিক, পুরনো ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ফি, আমদানি মোবাইল ফোন, বিদেশি চকোলেট, কফি, গ্রিন টি, আমদানি করা বাদাম, আমদানি মধু, ইউপিএস, আইপিএস, স্টাবিলাইজার, ছাপাখানার পণ্য, প্লাস্টিক ব্যাগ, মোবাইল ব্যাটারি চার্জার, নেলপলিশ, অ্যালকোহল বিক্রয়কারী হোটেল রেস্তরাঁয় সেবার মান, হেলিকপ্টার সেবা, বিড়ি, জর্দা, গুল, সোস্যাল মিডিয়া ও অনলাইন লাইন কেনাকাটায় খরচ বাড়বে।

জিডিপিতে বেসরকারিখাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বিদ্যমান ২৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে ২৫ দশমিক ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হলেও কর্পোরেট করের হার কমানো না হলে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। অথচ জিডিপিতে বিনিয়োগের পরিমাণ ১ শতাংশ বাড়াতে হলে প্রায় ২৪-২৫ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রয়োজন।

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ আইবএফবি প্রেসিডেন্ট হাফিজুর রহমান খান বলেন, উন্নয়নের ধারাবাহিকতার সঙ্গে বাজেটের আকার সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে বাজেট শুধু প্রণয়ন করলেই হবে না, তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

তিনি বলেন, কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো একটা ভালো সিদ্ধান্ত। বাজেটে দেশীয় শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে বেশ কিছু সুবিধা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে আইবিএফবির পক্ষ থেকে অনুন্নত জেলাগুলোকে এগিয়ে নিতে একটি জেলা বাজেটের প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছিল, সেটা হয়নি। আশা করছি, ভবিষ্যতে বিষয়টি বিবেচনা করা হোক।

‘বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংকিং খাত ও শেয়ার বাজারের জন্য তেমন কোনো দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়নি, যা থাকা উচিত ছিল’,- বলেন হাফিজুর রহমান খান।

এমএ/এমইউএইচ/জেডএ/পিআর

আরও পড়ুন