মালিকদের অনৈতিক দাবি মেনে নিচ্ছে আইডিআরএ
মালিক ও নির্বাহীদের অনৈতিক দাবি মেনে নিয়ে জীবন বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা বাড়িয়ে ‘লাইফ ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা বিধিমালা- ২০১৮’ এর খসড়া লেজিসলেটিভ বিভাগের ভেটিংয়ের জন্য পাঠিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
সরকার এ বিধিমালা চূড়ান্ত করে গেজেট আকারে প্রকাশ করলে জীবন বীমা কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যে আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে যে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেছে, এর বৈধতা পেয়ে যেতে পারে। এর মাধ্যমে এক শ্রেণির বীমা কোম্পানির মালিক ও নির্বাহীরা সুবিধা পাবেন। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বীমা পলিসি গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডাররা।
তবে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা বাড়ানোর পক্ষে থাকা বীমা কোম্পানিগুলোর শীর্ষ কর্তারা বলছেন, ব্যয় বাড়ার কারণে বীমা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। বরং বর্তমানে কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত যে ব্যয় হচ্ছে তা আইনিসীমার মধ্যে চলে আসবে।
মেঘনা লাইফের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা বাড়ানো হলে তা আমাদের (কোম্পানি) জন্য ভালো হবে। তবে গ্রাহকদের জন্য ভালো হবে না। কারণ কোম্পানি ব্যয় কম করলে গ্রাহক বেনিফিট বেশি পাবে। বিপরীতভাবে ব্যয় বেশি হলে বেনিফিট কিছুটা কম পাবে। তবে সীমা বাড়ানো হলে ব্যবস্থাপনা খাতে আইনিসীমার যে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হচ্ছিল তা হবে না। এদিক থেকে বীমা কোম্পানিগুলো সুবিধা পাবে।’
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি ও সন্ধানী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, ‘এখন যে আইন আছে তাতে কোনো জীবন বীমা কোম্পানি ব্যবস্থাপনা ব্যয় আইনিসীমার মধ্যে রাখতে পারছে না। তাই ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা বাড়ানো উচিত। এতে কোম্পানিগুলোর ব্যয় আইনিসীমার মধ্যে চলে আসবে।’
অনেক কোম্পানি পলিসি গ্রাহকদের ভালো মুনাফা দিতে পারছে না। এ পরিস্থিতে ব্যয় বাড়লে গ্রাহকদের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে কিনা- এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘যারা গ্রাহকদের মুনাফা দিতে পারে না, গ্রাহক তাদের কাছে যাবে কেন? এ ক্ষেত্রে তো গ্রাহকদের স্বাধীনতা আছে। যে কোম্পানি বেনিফিট দিতে পারবে, গ্রাহক সেই কোম্পানি থেকেই বীমা পলিসি কিনবে।’
ব্যবস্থাপনা ব্যয় সংক্রান্ত আইডিআরএ ভেটিংয়ের জন্য যে বিধিমালা পাঠিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, প্রথম পাঁচ বছর (ব্যবসা শুরুর পর পাঁচ বছর পর্যন্ত) বীমা কোম্পানিগুলো প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ৯৮ শতাংশ ও নবায়ন প্রিমিয়ামের ২৫ শতাংশ ব্যয় করতে পারবে। তবে বর্তমানে বলবৎ ১৯৫৮’র বিধিতে এ ব্যয়ের সীমা নির্ধারিত আছে। প্রথম তিন বছর প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামের সাড়ে ৯৭ শতাংশ এবং নবায়নে সাড়ে ২২ শতাংশ। আর চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ বছরে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামে সাড়ে ৯৬ শতাংশ ও নবায়নে ২০ শতাংশ।
অর্থাৎ খসড়া বিধিমালা বাস্তবায়িত হলে বীমা কোম্পানিগুলো প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহে বর্তমানের চেয়ে ১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বেশি খরচ করতে পারবে এবং নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ব্যবস্থাপনা ব্যয় করতে পারবে।
খসড়া বিধিমালায় ষষ্ঠ থেকে দশম বছরে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামের ৯৭ শতাংশ ও নবায়নের ২২ শতাংশ খরচের সুযোগ রাখা হয়েছে। অথচ আগের বিধিতে ব্যবসা শুরুর ষষ্ঠ থেকে দশম বছরে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামের ৯৫ শতাংশ এবং নবায়ন প্রিমিয়ামের ১০ শতাংশ খরচের অনুমোদন ছিল। অর্থাৎ খসড়া বিধিমালায় আগের চেয়ে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামে ২ শতাংশ এবং নবায়নে ১২ শতাংশ বেশি খরচের বিধান রাখা হয়েছে।
একই ভাবে খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, ১০ বছর পর ব্যবসা বলবৎ থাকলে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে এক থেকে ১০০ কোটি টাকার ৯৩ শতাংশ খরচ করতে পারবে বীমা কোম্পানিগুলো। ১০১ থেকে ৫০০ কোটি টাকা প্রিমিয়ামের ৯২ শতাংশ এবং ৫০১ থেকে তদুর্ধ টাকার প্রিমিয়ামের ৯১ শতাংশ খরচ করতে পারবে। আর নবায়ন প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কোম্পানির ব্যবসা শুরুর ১০ বছর পর থেকে নবায়ন প্রিমিয়ামের ২০ শতাংশ ব্যবস্থাপনা ব্যয় করতে পারবে।
তবে বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, বীমা কোম্পানির ব্যবসার বয়স ১০ বছর হলে গ্রাহকের জমা করা প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম থেকে ব্যবস্থাপনা ব্যয় করতে পারবে ৯০ শতাংশ এবং পরের বছরগুলোতে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ দুই কোটি টাকার নিচে হলে ১৮ শতাংশ এবং ১০ কোটি টাকার ওপরে হলে ১৫ শতাংশ ব্যয় করতে পারবে। অর্থাৎ ১৯৫৮’র বীমা বিধিমালার চেয়ে খসড়া বিধিমালায় নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে এবং প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ পর্যন্ত বেশি খরচের বিধান রাখা হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হলেও প্রতিবেশি দেশ ভারত তা কমিয়ে আনছে। বর্তমানে ভারতে ব্যবসা ১০ বছর পূর্ণ করা কোম্পানিগুলো ১০ বছরের বেশি মেয়াদে পলিসির জন্য প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহে ব্যয় করতে পারে ৮০ শতাংশ এবং নবায়নে ১৫ শতাংশ। যা আগের প্রবিধানে ছিল প্রথম বর্ষে ৯০ শতাংশ এবং নবায়নে ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ওপর ব্যবস্থাপনা ব্যয় ১০ শতাংশ কমিয়েছে ভারত।
বীমা সংশ্লিষ্টদের মতে, একটি জীবন বীমা কোম্পানির পলিসি গ্রাহকরা কেমন সুবিধা পাবেন তা নির্ভর করে ওই কোম্পানির ইনভেস্টমেন্ট রিটার্নের (বিনিয়োগ আয়) ওপর। আর কোম্পানির ইনভেস্টমেন্ট বা বিনিয়োগ নির্ভর করে কোম্পানির প্রিমিয়াম আয় থেকে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাদ দিয়ে থাকা উদ্বৃত্ত অর্থের ওপর। এক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত অর্থ বাড়লে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে। ফলে বাড়বে বিনিয়োগ আয়ের পরিমাণ। যার সুফল পাবেন বীমা গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডাররা। কিন্তু ব্যয় বাড়ালে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ কমে যাবে। ফলে গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডার উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
উদাহরণ হিসেবে একটি জীবন বীমা কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বর্তমানে ব্যবসায়িক কার্যক্রম ১০ বছর অতিক্রম করা একটি জীবন বীমা কোম্পানি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ৯০ শতাংশ এবং নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করছে। অর্থাৎ প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ১০ শতাংশ এবং নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ৮৫ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করে কোম্পানি লাভসহ বীমা গ্রাহকদের ফেরত দেয়।
এ নিয়মে ব্যবসা পরিচালনা করে বর্তমানে দেশে ব্যবসারত ৩২টি জীবন বীমা কোম্পানির মধ্যে হাতেগোনা তিন-চারটি কোম্পানি গ্রাহকদের কিছুটা মুনাফা দিতে পারছে। বাকি কোম্পানি থেকে গ্রাহকরা কোনো মুনাফা পাচ্ছে না। এর মূল কারণ কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় আইনিসীমার অতিরিক্ত হচ্ছে।
আইডিআরএ’র এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, ২০০৯-১৫ সাল পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা খাতে জীবন বীমা কোম্পানিগুলো এক হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা আইন লঙ্ঘন করে ব্যয় করেছে।
এ তথ্য বের হওয়ার পর তা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের অনুসন্ধানেও এর সত্যতা উঠে আসে। যে কারণে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর এ অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বীমা আইন সংশোধন করার জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় দুদক। এ পরিস্থিতিতে দুদকের হাত থেকে বাঁচতে দফায় দফায় বৈঠকে বসে বীমা কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা। তারা ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা বাড়িয়ে আইন পরিবর্তনের দাবি জানায়। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ সেই দাবি মেনে নিয়ে গ্রাহকদের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
এ বিষয়ে একটি কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বলন, ব্যয় বাড়ানো হলে গ্রাহক স্বার্থ ঝুঁকিতে পড়বে। ফলে বীমার প্রতি আগ্রহ হারাবে সাধারণ মানুষ। বীমা খাতে অন্ধকার নেমে আসবে। কেননা, ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেশি হওয়ায় গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। মৃত্যুদাবি, মেয়াদোত্তীর্ণ দাবি ও অন্তর্বর্তীকালীন বোনাস পরিশোধ না করার প্রচুর অভিযোগ ইতোমধ্যে উঠেছে বীমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে।
তিনি বলেন, গ্রাহকরা কষ্টার্জিত অর্থ বীমা কোম্পানিতে ১০, ১২, ১৫ ও ২০ বছরের জন্য জমা রাখেন ঝুঁকি মোকাবেলা এবং বৃদ্ধ বয়সে সঞ্চয়ের জন্য। বর্তমানে বীমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকের টাকা থেকে প্রথম বছরে ৯০ শতাংশ এবং পরবর্তী বছরগুলোতে ১৫ শতাংশ হারে ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করছে। বাকি অর্থ বিনিয়োগ করে লাভসহ গ্রাহকদের ফেরত দিচ্ছে। এতে দু-তিনটি কোম্পানি ছাড়া বাকি কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের কোনো মুনাফা দিতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে ব্যয়ের পরিমাণ যদি এক শতাংশও বাড়ানো হয় তবে তা গ্রাহকদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। মুনাফা তো দূরের কথা, কোম্পানি গ্রাহকদের আসল টাকাই ফেরত দিতে পারবে না।
অপর এক বীমা কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) নাম প্রকাশ না করে বলেন, যদি অনুমিত ব্যয়ের তুলনায় প্রকৃত খরচ বৃদ্ধি পায় তাহলে কোম্পানি ওই প্রডাক্ট বিক্রি বন্ধ করে দেবে এবং নতুন প্রডাক্ট তৈরি করবে। এক্ষেত্রে আইন পরিবর্তন করে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যয় বাড়ালে গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং জীবন বীমার প্রতি আগ্রহ কমে যাবে। এমনিতেই আমাদের দেশে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর ইমেজ খুব একটা ভালো নয়।
তবে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়ানোর পক্ষে সাফাই গাচ্ছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। আইডিআরএ’র সদস্য গোকুল চাঁদ দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়ার কারণে গ্রাহকদের বেনিফিট পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। ভারতের সঙ্গে আমাদের কোনো কিছু মেলানো যাবে না। তাদের পলিসির সঙ্গে আমাদের পলিসির কোনো মিল নেই।’
বর্তমানে নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ১৫ শতাংশ ব্যয় করেই বেশিরভাগ কোম্পানি গ্রাহকদের ভালো মুনাফা দিতে পারছে না, সেখানে ব্যয় আরও ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হলে গ্রাহকরা কীভাবে বেনিফিট পাবে- এমন প্রশ্ন করা হলে গোকুল চাঁদ তার কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে বলেন, ‘গ্রাহকরা বেনিফিট পাবেন।’
এমএএস/এমএআর/আরআইপি