আয়হীন কর্মসংস্থানে বাংলাদেশ : সিপিডি
কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি থেকে বাংলাদেশ আয়হীন কর্মসংস্থানে পরিণত হয়েছ বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। একই সঙ্গে দেশের ব্যাংকিং খাত বিকলাঙ্গ এবং এতিমে পরিণত হয়েছে বলে দাবি করেছে গবেষণা সংস্থাটি।
মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের সুপারিশ তুলে ধরতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সিপিডির পক্ষে এসব কথা বলেন সংস্থাটির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, ‘প্রবৃদ্ধি, উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আয় এই চারটির মধ্য সামঞ্জস্য আছে কি-না দেখতে হবে। এই চারটার মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকলে বুঝতে হবে আমাদের এমন ধরনের আয় হচ্ছে, যেটা নিয়ে চিন্তার বিষয়। আমরা দেখছি দেশে কর্মসংস্থান বাড়লেও আয় কমছে। অর্থাৎ দেশ আয়হীন কর্মসংস্থানে পরিণত হয়েছে’।
তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা এতদিন যেটা শুনেছেন কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি, শুনেছেন না জব লেস গ্রোথ। আজকে আমরা বলছি আয়হীন কর্মসংস্থান। আমরা কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি থেকে বের হয়ে আয়হীন কর্মসংস্থানে চলে গেছি’।
তিনি বলেন, ‘আপনারা প্রবৃদ্ধি ৬, ৭, ৮ যাই বলেন, তার ফলাফলটা আমরা কোথায় পাব। ফল তো প্রবৃদ্ধির হার দিয়ে হবে না। ফলাফল নির্ধারিত হবে জনমানুষের জীবনে কর্মসংস্থান হলো কি-না, আয় হলো কি-না তার ওপর। সরকারি প্রতিবেদন থেকে আমরা দেখছি, কর্মসংস্থান বেড়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি প্রকৃত আয় কমে গেছে’।
আয় কমার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যাদের আয় কমেছে তাদের মধ্যে নারীদের আয় বেশি কমেছে। একই সঙ্গে শহরের মানুষের থেকে গ্রামের মানুষের আয় বেশি কমেছে। এর সঙ্গে আমরা নতুন বিষয় দেখছি যারা পড়াশোনা করে তারা বেকার বেশি। আর শেষ যেটা দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়ছে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এতদিন আমরা উচ্চতর প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত হয়েছি। এই উচ্চতর প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আজকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে শোভন কর্মসংস্থান। কারণ যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, তা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। সেখানে আয় কম, সেখানে কোনো ধরনের শ্রমের অধিকার বা পরিবেশ নেই’।
তিনি বলেন, ‘যে প্রবৃদ্ধিটা হচ্ছে, সেটা পুরোটাই হচ্ছে সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে। ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ গত তিন বছর ধরে প্রায় একই স্থানে স্থবির হয়ে আছে। আমাদের কাছে প্রশ্ন জাগে যদি ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ স্থবির থাকে, তাহলে এই যে মুদ্রানীতিতে যেখানে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধরা হলো ১৬.৫ শতাংশ। অথচ বিতরণ হয়েছে ১৮ শতাংশের বেশি। তাহলে এই টাকা গেল কোথায়? ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ না বাড়ায় আয়হীন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে’।
আমদানির বিপরীতে অর্থ পাচার হচ্ছে কি-না খতিয়ে দেখা উচিত এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমদানি অভূতপূর্বভাবে বাড়ছে। পুঁজি পণ্যের আমদানির ভিতর দিয়ে অর্থ পাচার হচ্ছে কি-না এটা মনোযোগ দিয়ে দেখা উচিত। পুঁজি পণ্য আমদানি হচ্ছে, সরকারি ব্যাংকের টাকা যাচ্ছে, বেসরকরি ব্যাংকের টাকাও যাচ্ছে, কিন্তু বিনিয়োগ হচ্ছে না। এটা কেমন কথা! উৎপাদনের সঙ্গে মুদ্রানীতির পরিসংখ্যান, আমদানির পরিসংখ্যানের কোনো সামঞ্জস্য নেই’।
দেশে বিকলাঙ্গ ব্যাংকিং খাত সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারল্য ঘাটতির কথা বলে সরকার মুদ্রানীতি ঘোষণার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সিআরআর কমিয়ে দিয়ে মুদ্রার ফ্লো বাড়ানোর চেষ্টা করলো। আসলে তারল্য ঘাটতি একটি রোগের উপসর্গ, এটা কোন রোগ না। রোগ হলো আপনি (সরকার) একটি বিকলাঙ্গ ব্যাংকিং ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছেন। ব্যাংকিং খাত নিতান্তই এতিমে পরিণত হয়েছে। এর রক্ষক যারা আছে, তারাই এখন এই শিশু, এতিমের ওপর অত্যাচার করছেন। যাদের এটা রক্ষা করার কথা ছিল, তারাই বিভিন্ন চাপের মুখে বিভিন্ন কাজ করে বের হয়ে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছি বাংলাদেশে নির্বাচন আসলে একদিকে যেমন বিদেশ থেকে অনেকে রেমিটেন্সের টাকা পাঠায় নির্বাচনের অর্থায়নের জন্য, অপরদিকে তার থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে চলে যায়। অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা থাকলে এটি আরও বেশি যায়। টাকা এই ধরনের তসরুফ, অপব্যবহার ও বিদেশে পাচারের ক্ষেত্রে তিনটি জায়গা রয়েছে। একটি প্রথমটি ব্যাংকিং খাত, দুই নম্বর পুঁজিবাজার এবং তৃতীয়টি আমদানি।
আগামী বাজেটের বরাদ্দের বিষয়ে তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আরও বেশি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অংশ হিসেবে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ১.১ শতাংশের ওপরে নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে বরাদ্দ কোন খাত কতো খরচ করা হচ্ছে তা স্বচ্ছ হতে হবে, এর তথ্য আমাদের কাছে আসতে হবে।
নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চলনায় এতে আরও বক্তব্য রাখেন সিপিডির সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এবং গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থার রিসার্চ ফেলো তৌফিক ইসলাম খান।
মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য তুলে ধরে তৌফিক ইসলাম খান বলেন, গত অর্থবছরে ১৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তবে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সব থেকে বেশি। যেখানে অশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার ১.৫ শতাংশ, সেখানে উচ্চমাধ্যম পাশ করাদের বেকারত্বের হার ১৪.৯ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে ৫০ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি থাকতে পারে বলে মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন তিনি। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে দেবপ্রিয় বলেন, গত বছর আমরা ৪২ কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে বলে অভিমত দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে ঘাটতি পাওয়া যায় ৪৩ কোটি টাকা। এবার দেখা যাক কী হয়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীল দুর্বল জায়গায় রয়েছে এমন মন্তব্য করে তৌফিক ইসলাম খান মূল প্রবন্ধে আগামী বাজেটের জন্য বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করা, মানুষের করের টাকা ব্যাংকগুলোকে না দেয়া, বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কটের হাত থেকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা আরও ভালো করা, বকেয়া রজস্ব আদায়ে সরকার ও এনবিআরের আরও মনযোগী হওয়া, কর্পোরেট কর হার কমানোর ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করা এবং নতুন প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। পাশাপাশি এখন যে প্রকল্পগুলো আছে সেগুলো বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে হবে।
এমএএস/এমএমজেড/এমএস