ব্যবস্থাপনা দুর্বলতায় কৌশলগত বিনিয়োগকারীতে ধরা ডিএসই
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত বিনিয়োগকারী হতে চীনের দুই শেয়ারবাজার শেনঝেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি বংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পর্ষদের ব্যর্থতার কারণে চীনের দুই প্রতিষ্ঠানকে কৌশলগত বিনিয়োগকারী করার সুযোগ হাতছাড়া হতে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৌশলগত বিনিয়োগকারীরর কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাব ভালোভাবে বিশ্লেষণ না করে ডিএসইর পর্ষদ তা অনুমোদন পেতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে জমা দেয়। এর আগে ‘শেনঝেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাব খুবই আকর্ষণীয়’- ডিএসই পর্ষদের সদস্যরা অতিউৎসাহিত হয়ে সংবাদ মাধ্যমে এমন তথ্য সরবরাহ করেছে।
অথচ প্রথম থেকে বিএসইসির শীর্ষপর্যায় থেকে শেনঝেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ কনসোর্টিয়ামকে কৌশলগত বিনিয়োগকারী করার ক্ষেত্রে এক ধরনের বিরোধিতা করা হয়। এরপরও কনসোর্টিয়ামটির প্রস্তাব ভালোভাবে পর্যালোচনা না করেই তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন চাওয়া এক ধরনের বোকামি- এমনটি মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের বোর্ড সভায় চীনা কনসোর্টিয়ামকে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে বেছে নেয়া হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে চীনের কনসোর্টিয়ামকে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে অনুমোদনের জন্য ডিএসইর সচিব মো. আসাদুর রহমান বিএসইসিতে প্রস্তাব জমা দেন।
ওই দিনই (২২ ফেব্রুয়ারি) ডিএসইর প্রস্তাব পর্যালোচনা করতে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ আহমেদকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কমিটির সদস্য সচিব করা হয় নির্বাহী পরিচালক মো. মাহবুবুল আলমকে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন- নির্বাহী পরিচালক ড. এটিএম তারিকুজ্জামান ও মো. আনোয়ারুল ইসলাম।
ওই কমিটির পর্যালোচনায় উঠে আসে, চীনা কনসোর্টিয়াম যে প্রস্তাব দিয়েছে তার মধ্যে কিছু বিষয় বাংলাদেশের আইনের পরিপন্থি। ফলে সেই প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করার সুযোগ নেই বলে অভিমত তুলে ধরা হয়। তারই আলোকে বিএসইসি ডিএসইর কাছে ব্যাখ্যাও চায়।
কমিটির পর্যালোচনায় উঠে আসে, ডিএসইর সঙ্গে কৌশলগত বিনিয়োগকারীর চুক্তি যুক্তরাজ্যের আইন অনুযায়ী করার শর্ত দিয়েছে চীনের কনসোর্টিয়াম। সেই সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে কোনো বিরোধ দেখা দিলে তার সমঝোতা লন্ডনের আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন অনুযায়ী করার শর্ত দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নতুন কোনো কৌশলগত বিনিয়োগকারী অন্তর্ভুক্ত করতে চীনের কনসোর্টিয়ামের অনুমোদনও নিতে হবে- এমন শর্তও দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএসইসির কমিটি অভিমত ছিল, ওই তিন শর্তই বাংলাদেশের আইনের পরিপন্থী এবং তা বিবেচনার সুযোগ নেই। এছাড়া আর্টিকেলে প্রস্তাবিত ধারাগুলো সংযোজন করলে ডিএসই চাইনিজ কৌশলগত বিনিয়োগকারীর অনুমোদন ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে না।
চীনের কনসোর্টিয়ামের অন্য শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- নতুন কোনো শেয়ার ইস্যু, পরিচালকদের সংখ্যা পরিবর্তন, ১৫ শতাংশের বেশি যে কোনো স্থায়ী সম্পদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, একক বা যৌথভাবে ১০ কোটি টাকার বেশি ঋণ গ্রহণ, চুক্তি বা বিনিয়োগ করতে চীনের কনসোর্টিয়ামের লিখিত অনুমোদন নিতে হবে।
পাশাপাশি ডিএসইর আইপিও সংক্রান্ত যে কোনো ইস্যু যেমন শেয়ারের মূল্য, স্পন্সর নির্ধারণ, অবলেখক নিয়োগ, প্রসপেক্টাস অনুমোদন এবং ইস্যুমূল্য নির্ধারণেও লিখিত অনুমোদন লাগবে- এমন শর্তও জুড়ে দিয়েছে চীনের কনসোর্টিয়াম।
ডিএসইর আর্টিকেলের ১৩৫-এ একটি নিয়ন্ত্রণমূলক ধারা রয়েছে, ফলে ডিএসই যে কোনো শেয়ারধারী যার ন্যূনতম দশমিক ২৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে, তার সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে পারবে না। চাইনিজ কৌশলগত বিনয়োগকারী এ ধারা থেকে অব্যাহতি চেয়েছে। বিএসইসির কমিটির পর্যালোচনায় এমন তথ্যও উঠে আসে।
একই সঙ্গে আর্টিকেলে যাই থাক না কেন চাইনিজ কৌশলগত বিনিয়োগকারী তার ইচ্ছা অনুযায়ী যে কাউকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগদানের প্রস্তাব দিয়েছে এবং সেটেলমেন্ট গ্রান্টি ফান্ড কন্ট্রিবিউশন বাদ দেয়া বা স্থগিত করার প্রস্তাব দিয়েছে। এ বিষয়েও ডিএসইর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে বিএসইসি।
এদিকে চীনের কনসোর্টিয়াম যে ৩০০ কোটি টাকার কারিগরি সহায়তা দেবে বলে ডিএসই দাবি করছে, তা নির্ধারণে কোনো নিরপেক্ষ মূল্যায়ন নেই বলে বিএসইসির পর্যালোচনা কমিটির তদন্তে উঠে আসে।
এসব তথ্য তুলে ধরে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে ব্যাখা চাওয়া হলে ডিএসইর পক্ষ থেকে উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি বলে পরবর্তীতে কমিটির পর্যালোচনায় উঠে আসে। কমিটি অভিমত দেয়, কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুতে চীনের কনসোর্টিয়ামের স্বার্থ রক্ষার্থে ডিএসই কর্তৃপক্ষ স্বপ্রোণোদিত হয়ে অনেক শর্ত দিয়েছে।
এছাড়া কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুতে বিএসইসি ব্যাখ্যা চাইলেও ডিএসই কর্তৃপক্ষ তা করেনি। বরং বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছে। এক্ষেত্রে ডিএসই ২৫ শতাংশ শেয়ারধারীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে স্থানীয় ৭৫ শতাংশ শেয়ারহোল্ডারের স্বার্থ বিসর্জন কেন দিতে চেয়েছে তা জানতে চায় বিএসইসি।
বিএসইসির পর্যালোচনা কমিটির মতে, চীনের কনসোর্টিয়াম ২২ টাকা করে দেবে বলে ডিএসই সর্বত্র প্রকাশ করেছে। তবে লভ্যাংশ দিলে সমপরিমাণ মূল্য কমে যাবে বলে প্রস্তাবিত ডকুমেন্টে বলা হয়েছে। এমতাবস্থায় শেয়ারের দাম ২২ টাকা কী করে থাকে তা জানতে চায় বিএসইসি। একই সঙ্গে বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডাররা বিষয়টি জানে কি-না তাও জানতে চায়।
বিএসইসির চিঠির জবাবে ডিএসই দাবি করে, চীনের কনসোর্টিয়ামের সব প্রস্তাব আইনসম্মত। তবে এতগুলো বিরোধপূর্ণ শর্ত থাকার পরও কীভাবে আইনসম্মত তা জানতে চায় বিএসইসি।
এদিকে বিএসইসির চিঠির আলোকে ডিএসই কৌশলগত বিনিয়োগকারীর চুক্তি যুক্তরাজ্যের (ইউনাইটেড কিংডম) পরিবর্তে বাংলাদেশের আইনে করবে বলে জানায়। তবে ডিএসইর এমন ব্যাখ্যা সন্তুষ্ট করতে পারেনি বিএসইসিকে। ফলে চীনের কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। তবে কিছু শর্ত পরিপালন ও সংশোধিত প্রস্তাব দাখিল করার জন্য ডিএসইকে সুযোগ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- শেয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্টে (এসপিএ) এমন কোনো শর্ত রাখা যাবে না, যা স্থানীয় আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি ডিএসইর সাধারণ শেয়ারহোল্ডার ও বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট উন্নয়নের বিরুদ্ধে না যায়। এমন কোনো প্রস্তাব রাখা চলবে না, যা পরিপালন করতে ডিএসইর বিদ্যমান মেমোরেন্ডাম এবং আর্টিকেলস অব অ্যাসোসিয়েশন সংশোধন করতে হয়। এসপিএসহ কৌশলগত ইস্যু চূড়ান্ত করে কমিশনে জমা দেয়ার আগে ডিএসইর শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নিতে হবে। কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুতে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন ডিএসইর সাধারণ সভায় উপস্থাপন করতে হবে। ডিএসইর সাধারণ সভার সিদ্ধান্তপত্র, এসপিএসহ কনসোর্টিয়ামের অন্যান্য কাগজাদি নিয়ে কমিশনে চূড়ান্ত আবেদন করতে হবে।
এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, চীনের কনসোর্টিয়ামকে কৌশলগত বিনিয়োগকারী করতে পারলে তা দেশের শেয়ারবাজারের জন্য খুবই ইতিবাচক হবে। বাজারে দীর্ঘ মেয়াদে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়তো। কিন্তু বিএসইসি যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তাতে বাজারে উল্টো নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ওই সদস্য বলেন, বিএসইসির তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চীনা কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাবে অনেকগুলো বিরোধপূর্ণ শর্ত রয়েছে। অথচ ডিএসইর পর্ষদ থেকে বিভিন্নভাবে তথ্য রটানো হয়েছে তাদের প্রস্তাব খুবই আকর্ষণীয়। এতে এটা স্পষ্ট ডিএসইর পর্ষদ চরমভাবে ব্যর্থ। এর আগে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পর্ষদের কয়েকজনের কর্মকাণ্ড বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। একজন এজিএম প্রতিবাদ করে চাকরি ছেড়েছেন। আর এক কর্মী প্রকাশ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। এসবই দুর্বল ব্যবস্থাপনার ফল।
ডিএসইর আরেক সদস্য বলেন, বর্তমানে ডিএসইর যে ব্যবস্থাপনা পর্ষদ আছে তা একটি অথর্ব পর্ষদ। এমন মেরুদণ্ডহীন পর্ষদ ডিএসইতে কখনও ছিল না। ব্যবস্থাপনা পর্ষদে যারা আছেন, তারা শুধুই নিজেরা কীভাবে সুবিধা বাগিয়ে নেবেন সেই ধান্দায় আছেন। দুজন নিজেদের অস্থায়ী চাকরি স্থায়ী করে নিয়েছেন। আবার এমডি, সিএফও-এর কাছের একাধিক কর্মকর্তার বেতন বাড়ানো হয়েছে অস্বাভাবিক হারে। এ নিয়ে কর্মকর্তা প্রতিবাদও করেছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি তো তার সবকিছুই জানে। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোনো পদক্ষেপ নিলো না। অথচ কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুতেই বিএসইসি তার যত রাগ ঝাড়লো। এটা তো বাজারের জন্য কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না।
যোগাযোগ করা হলে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, আগের প্রস্তাবে যাই হোক, এখন আমরা বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রস্তাব জমা দেব। প্রস্তাব জমা দেয়ার ক্ষেত্রে পর্ষদের কোনো দুর্বলতা ছিল কিনা- এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটাকে আমি ব্যর্থতা বলবো না। আমরা এখন আইন অনুযায়ী প্রস্তাব জমা দেব। সেক্ষেত্রে সঠিকভাবে প্রস্তাব জমা দিতে পারলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
এমএএস/এমএমজেড/এমএআর/এমএস