জিএসপি নয়, বাংলাদেশের স্বার্থে এফটিএ সম্পাদনে গুরুত্বারোপ
নিকট ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ কারণে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সম্পাদনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
তবে এফটিএ’র শর্তসমূহ বাংলাদেশের পক্ষে যাতে থাকে সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এমন অভিমত ব্যক্ত করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এফটিএ চুক্তিতে অবশ্যই বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর প্রতি প্রাধান্য দিতে হবে। সে কারণে চুক্তির বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য চুক্তির আগে সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভেতরে পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিয়ে জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সরকার নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা প্রদান করবে- এমন সম্ভাবনা কম। এ পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে উভয় দেশের মধ্যে এফটিএ স্বাক্ষরের কৌশল গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে। দুই দেশের বাণিজ্যে এফটিএ’র প্রভাব বিশ্লেষণে বিস্তারিত গবেষণা পরিচালনারও প্রস্তাব দেন রাষ্ট্রদূত।
ওই চিটির পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ড. এ কে এম আতিকুল হক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য এফটিএ’র বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জাগো নিজকে বলেন, ‘আগামী ৬-৭ বছর পর বাংলাদেশ আর স্বল্পোন্নত দেশ থাকছে না। এ কারণে এতদিন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে জিএসপির আওতায় যেসব সুবিধা পেতাম সেগুলো সংকুচিত হবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এফটিএ সম্পাদনের যৌক্তিকতা রয়েছে।’
‘এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ সম্পাদনের ব্যাপারে সাম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খতিয়ে দেখতে পারে। এটি শুধু পণ্যভিত্তিক হবে না, পণ্য ও সেবা উভয় ভিত্তিক হবে। এর সঙ্গে বাণিজ্য যুক্ত হবে কিনা- সে বিষয়গুলো নিয়ে পর্যাপ্ত বিশ্লেষণের দরকার আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আরও বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে যে, কোন কাঠামোতে এফটিএ সম্পাদন করলে বাংলাদেশ বেশি লাভবান হবে।’
জিএসপি না এফটিএ- কোনটিতে বেশি সুবিধা; এ বিষয়ে তিনি বলেন, “জিএসপি’র আওতায় যে সুবিধা আমরা পেয়েছিলাম, সেটি ছিল সীমিত আকারে। এফটিএ’র ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষীয় যে চুক্তি বা বাণিজ্য বিনিয়োগ চুক্তি হয় এবং সেটি যদি বাংলাদেশ নিজেদের জন্য উপযুক্ত শর্তে করতে পারে তাহলে জিএসপি’র চেয়ে এফটিএ’তে আমরা বেশি সুবিধা পাব। তবে বাংলাদেশ এটি কতটুকু নিজেদের পক্ষে নিতে পারে সেটিই মূল বিষয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আগেই আইডেন্টিফাই (চিহ্নিত) করে প্রস্তুতি নিতে হবে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নেগোসিয়েট করে চূড়ান্ত চুক্তিতে উপনীত হতে হবে। সবকিছুর আগে প্রয়োজন, এ সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্তগুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভেতরেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা। সে ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদেরও অভিমত নেয়া যেতে পারে।’
উল্লেখ্য, রানা প্লাজা ধস এবং তাজরীন ফ্যাশন্সে অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক হতাহতের পর আন্তর্জাতিকমানের শ্রম পরিবেশ না থাকার অভিযোগে ২০১৩ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে ওবামা প্রশাসন। ওই সুবিধা ফিরে পেতে পোশাক কারখানায় কাজের পরিবেশের উন্নয়নসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি খাতে পরিবেশ উন্নয়নের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। এরপর তৈরি পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে উন্নয়ন করলেও জিএসপির ওপর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়নি।
এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বরাবরই বলে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জিএসপি পাওয়ার আর আশা করেন না তিনি। সম্প্রতি সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আমরা জিএসপি সুবিধা পাওয়ার আশা করি না। কারণ আমরা যতই অগ্রগতি লাভ করি না কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে এ সুবিধা দেবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এ সুবিধার প্রয়োজনও নাই। কারণ আমরা অচিরেই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর হচ্ছি। উন্নয়নশীল দেশে যখন রূপান্তরিত হব তখন তো জিএসপির কোনো প্রশ্নই আসে না।’
২০১৩ সালের ২৭ জুন জিএসপি স্থগিতের ঘোষণার আগে প্লাস্টিকসামগ্রী, সিরামিক, চা, ফার্নিচার, সবজি, তামাকজাতপণ্য, খেলার সরঞ্জাম, রান্নাঘরের সামগ্রী, গলফসামগ্রী ও চশমা, লবণ, পাথর, সিমেন্ট, জাহাজসহ রফতানি তালিকার ছোটখাটো আরও কিছু পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা পেত। রফতানি খাতের প্রধান পণ্য তৈরি পোশাক, চিংড়ি, চামড়াসহ বাকি পণ্যগুলো কখনও যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি সুবিধার আওতাভুক্ত ছিল না। দেশটির জিএসপি সুবিধা পেতে পারে এমন তালিকায় পাঁচ হাজারের বেশি পণ্য রয়েছে। তবে বেশিরভাগই বাংলাদেশ রফতানি করে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জিএসপি স্থগিতে বাংলাদেশের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ দেশের প্রধান রফতানিপণ্য তেরি পোশাকে জিএসপি সুবিধা দিত না যুক্তরাষ্ট্র। তবে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা স্থগিতের পর ২০১৭ সালের মে পর্যন্ত সে দেশে চায়ের রফতানি কমেছে ৮৫ শতাংশ, সিরামিকের কমেছে ২৬ শতাংশ, প্লাস্টিকের ২৩ শতাংশ এবং খেলনা পণ্যে রফতানি কমেছে সাত শতাংশ।
এমইউএইচ/এমবিআর/এমএআর/পিআর