শেয়ারবাজারের জন্য কি সুখবর?
ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণ (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর) সাড়ে ছয় শতাংশ থেকে এক শতাংশ কমিয়ে সাড়ে পাঁচ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সংবাদে দেশের শেয়ারবাজারে দেখা দিয়েছে উল্লম্ফন। টানা তিন কর্যদিবসে মূল্যসূচকে বড় উত্থান হয়েছে।
সিআরআর কমানো এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সরকারের আমানত বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কারণে বাজারে তারল্য বাড়বে এবং ব্যাংক খাতে দেখা দেয়া অর্থসঙ্কট কেটে যাবে- এমন গুঞ্জন ছড়ানোর কারণে এমন উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন এ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। এতে আমানতের সুদহার কমে যাবে এবং এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে প্রবেশ করবে বলে ধারণা তাদের।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সিআরআর কমানো এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সরকারের আমানত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। এতে সার্বিক আর্থিক খাতে ঝুঁকি বাড়বে। বেড়ে যাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। আর শেয়ারবাজারে প্রাথমিকভাবে ইতিবাচক প্রভাব পড়লেও, বাস্তবে এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে শেয়ারবাজারের তেমন সম্পর্ক নেই।
ব্যাংক খাতের তারল্য সঙ্কট এবং শেয়ারবাজারের মন্দা অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে গত রোববার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের (বিএবি) সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান, বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা এস কে সুর চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।
ওই বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী জানান ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণ সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে এক শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সুদের হার কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এরই অংশ হিসেবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত ৫০ শতাংশ রাখা হবে। ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
এত পরিমাণ টাকা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে দেয়া হলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে কিনা- জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি বাড়বে না, কোনোভাবেই বাড়বে না। নীতিমালা অনুযায়ী এতদিন সরকারি আমানতের মাত্র ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার বিধান ছিল। আর আমানতের ৭৫ শতাংশ রাখা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। এখন থেকে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ পাবে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।’
অর্থমন্ত্রীর ওই ঘোষণার আগে বৃহস্পতিবার শেয়ারবাজারে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে ব্যাংকগুলোর তারল্য বাড়াতে বড় ধরনের সুযোগ দিতে যাচ্ছে সরকার। সেই সঙ্গে সিআরআর হারও কমানো হচ্ছে। এ গুঞ্জনে ভিত্তি করে টানা পতন থেকে বেরিয়ে বৃহস্পতিবার ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইক্স বাড়ে ১০৮ পয়েন্ট। পরের কার্যদিবস রোববার বাড়ে ১৪৯ পয়েন্ট এবং সোমবার বাড়ে ৮০ পয়েন্ট। অর্থাৎ টানা তিন কার্যদিবসে ডিএসইএক্স বেড়েছে ৩৩৭ পয়েন্ট।
সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিআরআর কমানোর সিদ্ধান্ত অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপ্রয়োজনীয়। কারণ হয়তো দুই-চারটি ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট থাকতে পারে। সার্বিকভাবে ব্যাংকিং সিস্টেমে কোনো তারল্যের সঙ্কট নেই, বরং মিনিমাম যেটা থাকার কথা তার থেকে বেশি আছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ক্যাশ রিজার্ভ ১২ হাজার কোটি টাকার মতো বেশি আছে। কাজেই এটা করে কোনো ফায়দা হবে না। বরং ঋণের প্রবাহ বেড়ে গেলে অযোগ্যরাও ঋণ পাবে এবং খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে। ফলে আর্থিক খাতে ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়বে।’
সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যাংক সরকারের, টাকাও সরকারের। সুতরাং আমানতের ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংকগুলো অগ্রাধিকার পাবে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকে সরকারের আমানত ৫০ শতাংশ দেয়া কিছুতেই ঠিক হবে না। এ টাকা যদি ভালো ব্যাংক ছাড়া সমস্যায় থাকা ব্যাংকে যায়, তাহলে দেখা যাবে সরকারি ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। সুতরাং এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না।’
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, ‘সিআরআর কমানো এবং বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত শেয়ারবাজারের জন্য ভালো সংবাদও নয়, আবার খারাপ সংবাদও নয়। আমাদের শেয়ারবাজার উল্টাপাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায়। সিআরআর কমানো হয়েছে, সুতরাং শেয়ারবাজারে অনেক টাকা যাবে, এমন একটা চিন্তাভাবনা আছে। কিন্তু আসলে কতোটুকু অর্থ যাবে সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু আমাদের বিনিয়োগকারীরা তো হুজুগে মাতে।’
ডিএসইর সাবেক সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এর ফলে অন্তত আগামী নির্বাচন পর্যন্ত মানি-মার্কেটে টাকার সঙ্কট থাকবে না। যেভাবে সুদের হার বাড়িয়ে আমানত সংগ্রহ করা হচ্ছিল, সেটা কমে যাবে। এই প্রথম অর্থমন্ত্রী কোনো ঘোষণা দিলেন সঙ্কট তৈরি হওয়ার আগেই। এটি করা না হলে সঙ্কট আরও বাড়তো। বাস্তবতা হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী কখনোই ব্যাংকারদের সঙ্গে পারেন না। এবারও ব্যাংকারদের কাছ অর্থমন্ত্রী নতিস্বীকার করলেন।’
তিনি বলেন, ‘সিআরআর এক শতাংশ কমানোর কারণে ব্যাংকগুলো ১০-১৫ হাজার কোটি টাকার সাপোর্ট পাবে। তবে এতে কারও পারফরমেন্স বাড়বে না, খেলাপি ঋণও কমবে না। আবার শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগও বাড়বে না। তবে শেয়ারবাজার থেকে ব্যাংকের বিনিয়োগ উঠিয়ে নেয়ার যে শঙ্কা ছিল, সেটা হবে না। সেই সঙ্গে সুদের হারও কমে আসবে। আর সুদের হার কমলে মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে শেয়ারবাজার।’
সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে দেয়ার কারণে আর্থিক খাতে ঝুঁকি সৃষ্টি হবে কিনা- জানতে চাইলে এই শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘দু-চারটা ব্যাংকের জন্য তো সমগ্র ব্যাংকিং খাত খারাপ হতে পারে না। এক ফার্মার্স ব্যাংকের কারণে দেশের পুরো ব্যাংক খাত খারাপ চলছে, এ কথা বলা যাবে না।’
এমএএস/এমএমজেড/এমএআর/পিআর