রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি : বিকল্প চিন্তা সরকারের
তীব্র সমালোচনার মুখেও গত আট বছরের ধারাবাহিকতায় বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে মূলধন সরবরাহে চলতি বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা। কিন্তু একের পর এক অনিয়ম, আর্থিক কেলেঙ্কারি আর চরম অব্যবস্থাপনায় বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত সরকারি খাতের ছয় ব্যাংকে বর্তমানে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা। এ কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে এবার অর্থিক সহায়তার পাশাপাশি বিকল্প চিন্তাও করছে সরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো জনগণকে যেসব সেবা ফ্রি দিচ্ছে সেসব সেবায় ন্যূনতম চার্জ আরোপের চিন্তা চলছে। এসব ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতি নিয়ে বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে গুরুত্বের সঙ্গে এসব বিষয় আলোচিত হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমানের সভাপতিত্বে বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিসহ সরকারি খাতের বাণিজ্যিক তিন ব্যাংক- সোনালী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংক এবং বিশেষায়িত তিন ব্যাংক- কৃষি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন (রাকাব) ও গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকে ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিদের নিকট জানতে চাওয়া হয় তাদের ব্যাংকগুলোর মূলধনের অবস্থা এত খারাপ কেন?
এ বিষয়ে প্রতিনিধিরা জানান, বেসরকারি খাতের ব্যাংক যেসব সেবায় নির্দিষ্ট হারে ফি আদায় করে এমন ৪০টি সেবায় সরকারি ব্যাংকগুলো কোনো ফি নেয় না। এসব সেবায় ফি নেয়া হলে মূলধনের অবস্থা এতটা খারাপ হতো না। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘ওইসব সেবায় সর্বনিম্ন চার্জ ধরে একটি গাইডলাইন প্রস্তুত করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখতে বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিকে অনুরোধ জানানো হয়।
বৈঠকে ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকারের নিকট অর্থ চাওয়া হয়েছে সে অর্থ পেলে তাদের কী সুবিধা হবে? তারা কতটুকু রিকভারি করতে পারবে অর্থাৎ তাদের টোটাল বিজনেস পলিসি প্রস্তুত করে পুনরায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ খাতে চলতি বাজেটে বরাদ্দ রয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো তাদের টোটাল বিজনেস পলিসি পাঠালে সে অনুযায়ী দুই হাজার কোটি টাকা থেকে কিছু কিছু করে দেয়া হবে। সহায়তা পেতে অনেক বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনুসুর রহমান বলেন, আজকের বৈঠকে তেমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামীতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হল-মার্ক, বিসমিল্লার মতো বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্ম দেয়া রাষ্ট্রমালিকানার ব্যাংকগুলোর কাঁধে আনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের বোঝা। একই সঙ্গে এসব ব্যাংক বছরের পর বছর ভুগছে বড় আকারের মূলধন ঘাটতিতে। খুঁড়িয়ে চলা এসব ব্যাংককে গত আট বছরে বাজেট থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপরও সরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
বছরের পর বছর মূলধন জোগান দিয়ে ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার তীব্র সমালোচনা করছেন অর্থনীতিবিদরা। জনগণের স্বার্থ রক্ষায় ব্যাংকগুলো করা হলেও এখন তা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ব্যাংকগুলোতে যা হয়েছে তা নিজেদের দোষে, তাদের দুর্নীতির কারণে। সব জায়গায় ছিল অব্যবস্থাপনা আর রাজনৈতিক প্রভাব। এখন যা হওয়া উচিত তা হলো ন্যারো ব্যাংকিং।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, অনিয়ম, দুর্নীতি আর চরম অব্যবস্থাপনার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা আদায় করা যাচ্ছে না। ফলে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে গিয়ে মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোকে জনগণের করের টাকা না দিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করে সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের তাগিদ দেয়া উচিত।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকগুলোকে সহায়তার মাধ্যমে অপচেষ্টা, চুরি এবং দিনে-দুপুরে ডাকাতিকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। খুব বেশি হলে একটি ব্যাংক রেখে বাকিগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত মিলিয়ে সরকারি খাতের ছয় ব্যাংকে ১৫ হাজার ৯০৮ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি সাত হাজার ৬২৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের ঘাটতি আট হাজার ২৮২ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি রয়েছে সোনালী ব্যাংকের। এ ব্যাংকের ঘাটতি তিন হাজার ১৪০ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি দুই হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এছাড়া জনতা ব্যাংকের ঘাটতি এক হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৬৯০ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংক প্রথমবারের মতো ঘাটতিতে পড়েছে।
সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত খাতের কৃষি ব্যাংকের ঘাটতি সাত হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ঘাটতি ৭৪২ কোটি টাকা।
সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ও অগ্রণী ব্যাংকে কোনো মূলধন ঘাটতি নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৭ সাল থেকে ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকগুলোকে ৪০০ কোটি টাকা অর্থাৎ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের বেশি পরিমাণ অর্থ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। ঝুঁকি মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে ১০ শতাংশ ন্যূনতম মূলধনের পাশাপাশি দশমিক ৬২ শতাংশ হারে অতিরিক্ত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়।
এমইউএইচ/জেডএ/এমএআর/জেআইএম