মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি একমুখী না হলে অর্থনীতির জন্য বোঝা
মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি যদি একমুখী না হয় তখন তা অর্থনীতির জন্য এটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই একটা অর্থনীতিকে সুচারুরূপে কার্যকরী রাখার জন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে গভীর সংলাপ ও সমন্বয় থাকা প্রয়োজন।
রোববার রাজধানীর বিআইবিএম অডিটরিয়ামে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে একক বক্তৃতায় এসব কথা বলেন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) সাবেক গভর্নর ড. চক্রবর্তী রঙ্গরাজন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির।
রঙ্গরাজন বলেন, অর্থনীতির বিবর্তনের ধারায় উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় দেশসমূহে মুদ্রানীতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বর্তমানে আবির্ভূত হয়েছে। এক্ষেত্রে মুদ্রানীতির চ্যালেঞ্জসমূহ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আজকের মুদ্রা ব্যবস্থা এবং আর্থিক ব্যবস্থা অনেক বেশি জটিলতর।
তিনি বলেন, আর্থিক সেবাসমূহের সংখ্যা এত বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে যে কয়েক দশক আগেও অনেক আর্থিক সেবা অপরিচিত ছিল যা আজ অতি সাধারণ ও পরিচিত আর্থিক সেবায় পরিণত হয়েছে। মুদ্রানীতি সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় এ সমস্ত পরিবর্তনসমূহ অনেক বেশি ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে দ্রুতগতিতে ফান্ডসমূহ এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন দেশসমূহের মধ্যে মুদ্রানীতি সমন্বয়ের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
মুদ্রানীতির উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে একটা ব্যালেন্স আনার সঙ্গে সঙ্গে দেশ-বিদেশের প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশের যুগান্তকারী পরিবর্তনের সঙ্গে এর খাপ খাওয়ানোর দরকার হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে মুদ্রানীতির অনেক উত্থান পতন হয়েছে। শিল্পোন্নত দেশসমূহে মূল্যস্ফীতির প্রতিরোধে মুদ্রানীতি অর্থনৈতিক পলিসির একটি সম্ভাবনাময় হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ভারতীয় মুদ্রানীতির ইতিহাস পর্যালোচনার ক্ষেত্রে ড. রঙ্গরাজন বলেন, স্বাধীনতার পর প্রথম তিন দশকে সরকারের প্রধান কাজ ছিল পরিকল্পনাসমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন। বাংলাদেশেও তার পার্থক্য হওয়ার কথা নয়। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক অবকাঠামো উন্নয়নে এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আশির দশকে এসে ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থমন্ত্রণালয়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং রাজস্ব ঘাটতি পূরণে স্বয়ংক্রিয় মানিটাইজেশন নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব দেখা যায়। এর পরের বছরগুলোতে রাষ্ট্রীয় অনেক কমিটির মতামতসমূহ কম বা বেশি বাস্তবায়িত হলেও ২০১৬ সালে এসে ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নমনীয় মূল্যস্ফীতি নির্ধারণের নীতির উপর ভিত্তি করে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে। কিন্তু এক্ষেত্রে সুদহার কখন বাড়ানো হবে আবার কখন কমানো হবে তা নিয়ে সবসময়ই একটা বিতর্ক রয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুদ্রানীতির লক্ষ্যসমূহ বিভিন্নভাবে বিধৃত হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় বাংকের মূল লক্ষ্য হলো সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মূল্য কাঠামো স্থিতিশীল রাখা। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির একটি সীমা নির্ধারণের মাধ্যমে তাদের লক্ষ্যসমূহ ঘোষণা করে। তবে মূল্যস্ফীতির টার্গেটিং এর জন্য রচিত মুদ্রানীতির সুবিধা ও অসুবিধা উভয়ই আছে।
ড. রঙ্গরাজন প্রশ্ন তোলেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা নিয়ে। তিনি লক্ষ্য অর্জনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথেষ্ট ইনস্ট্রুমেন্টস আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। যখন অতিরিক্ত চাহিদা হতে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয় তখন এ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতাকে মেনে থাকে। তবে যখন সরবরাহ সংকট থেকে এ মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা সম্পর্কে কিছু সন্দেহের জন্ম দেয়। ভারত ও বাংলাদেশের মতো দেশসমূহ যেখানে কৃষিজ উৎপাদন অনেকটা প্রকৃতির খামখেয়ালির উপর নির্ভরশীল সেখানে এ জাতীয় সরবরাহ সংকট অহরহ দেখা যায়। যখন খাদ্য মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়, তখন মূদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি যৌথভাবে ভূমিকা রাখতে হয়। যখন খাদ্য মূল্যস্ফীতি দীর্ঘ হয় এবং এটা যখন মূল্যস্ফীতির গ্রহণযোগ্য মাত্রা অতিক্রম করে তখন মুদ্রানীতিকে অবশ্য এভাবে পরিচালনা করতে হবে যাতে করে আর্থিক সম্পদের রিটার্ন প্রকৃত পক্ষে ধনাত্বক হয়।
মুদ্রা বিনিময় হার প্রসঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাবেক এ গভর্নর বলেন, উন্নত বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসমূহ সাধারণত মুদ্রা বিনিময়ের হারকে মার্কেটের উপর ছেড়ে দেয়। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন উন্নত বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকসমূহ মুদ্রা বিনিময় হারকে স্থিতিশীল করার জন্য কখনও এককভাবে, আবার কখনও সম্মিলিতভাবে বাজারে হস্তক্ষেপ করে।
উন্নয়নশীল দেশসমূহের ক্ষেত্রে বর্তমানে মূল্যস্থিতিশীলতা অর্জন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য হলেও বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ড. চক্রবর্তী বলেন, প্রায় সমস্ত দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। তবে অধিকাংশ সরকারই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামতকে গুরুত্ব দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো যুক্তি হলো আর্থিক স্থিতিশীলতা যা কিনা আধুনিক দক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য অত্যাবশ্যক, সেটা কেবল কিছু দক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের দ্বারা দীর্ঘমেয়াদী মুদ্রানীতি তৈরি ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সম্ভব। তবে তিনি বলেন, মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি যদি একমুখী না হয় তখন তা অর্থনীতির জন্য এটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই একটা অর্থনীতিকে সুচারুরূপে কার্যকরী রাখার জন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে গভীর সংলাপ ও সমন্বয় থাকা প্রয়োজন।
আর্থিক অবকাঠামো নিয়ে তিনি বলেন যে, যথোপযুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান তৈরিতে এবং আর্থিক অবকাঠামোর বিস্তৃতকরণের ক্ষেত্রে উন্নয়শীল দেশসমূহের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসমূহের একটি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাসমূহ এবং ঝুকিপূর্ণ গ্রুপের কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছানোর ব্যাপারে আর্থিক ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আর্থিক অন্তর্ভূক্তির ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করছে।
ভারত, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং এটা চালু রাখা প্রয়োজন। মুদ্রানীতির বড় সুবিধা হলো এটা যেকোনো পরিবর্তনে দ্রুত সাড়া দেয়। ক্রেডিট ও অর্থের মূল্য এবং প্রাপ্তিতে পরিবর্তন এনে মুদ্রানীতি অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে এ প্রভাব নগণ্যও হতে পারে। ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় তারল্য ফাঁদের কারণে মুদ্রানীতির প্রভাব ছিল না বললেই চলে। ২০০৮ সালে আর্থিক সংকটের পর উন্নত বিশ্বে সুদহার শূন্যের কোটায় পৌঁছায় এবং এর ফলে মুদ্রানীতি আবার অর্থনীতিকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে দুর্বল বলে প্রতীয়মান হয়।
মুদ্রানীতির অনেক লক্ষ্য থাকলেও অগ্রাধিকার ভিত্তিক সঠিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে এর বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। ক্রমবর্ধমান আর্থিক ব্যবস্থার জটিল আবর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কাজ করতে হচ্ছে বিধায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ম্যানডেটও অনেক বিস্তৃত হয়েছে। তবে মুদ্রানীতির অন্য লক্ষ্যসমূহ থেকে আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষাকল্পে মুদ্রানীতির উপযুক্ত হাতিয়ারও পর্যাপ্ত নয়। নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্ববধানের সুন্দর সমন্বয়ের সঙ্গে যথোপযুক্ত মনিটরিং আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য আবশ্যক।
তিনি পরামর্শ দেন যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার লক্ষ্যের ব্যাপারে আরও স্বচ্ছ ও বহির্মুখী হতে হবে। তবে যেটা বেশি প্রয়োজন তা হলো প্রচলিত নিয়ম ও বিচারিক বিচক্ষণতার একটা সুন্দর সমন্বয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য যেমন মূল্য স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আর্থিক স্থিতিশীলতা ইত্যাদির মধ্যে মূলস্থিতিশীলতার লক্ষ্যটি বেশি জোরালো হতে হবে। মূল্যস্ফীতির টার্গেটিং এক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
এসআই/এমবিআর/জেআইএম