নতুন করারোপ হচ্ছে না আগামী বাজেটে
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। প্রাথমিকভাবে আগামী (২০১৮-১৯) অর্থবছরের বাজেটের আকার নির্ধারণ হয়েছে চার লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। মোট রাজস্বপ্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা হবে তিন লাখ ৪০ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা, যা চলতি (২০১৭-১৮) অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি।
মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। টাকার অঙ্কে জিডিপি হবে ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে ২২ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, পূরণ না হলেও প্রতি বাজেটে বড় লক্ষ্যমাত্রা দেয়ার রীতি থেকে বের হতে পারছেন না অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ রীতি বজায় রেখে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটেও বিশাল রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দিচ্ছেন তিনি। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাজস্ব আদায়ের যে টার্গেট নির্ধারণ হচ্ছে তা আদায় হবে নতুন কোনো করারোপ ছাড়াই। করের আওতা বাড়িয়ে এ টার্গেট পূরণের চেষ্টা হবে। তবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হলেও সমস্যা নেই। কারণ অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে সম্পূরক বাজেটে তা কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, সরকার আশা করছে আগামী অর্থবছরে দেশে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে না। দেখা গেছে, যে বছর দেশে বড় আকারের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, পরের বছর সে ধরনের কোনো দুর্যোগ হয় না। চলতি বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বড় ধরনের বন্যা হয়েছিল। বিশেষ করে সিলেটের হাওর এলাকায় বন্যা ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। হাওরের বাঁধ ভেঙে সেখানে অনেক ধানিজমি পানিতে তলিয়ে যায়। নষ্ট হয় বিপুল শস্য। কিন্তু আগামী বছর এ ধরনের বন্যার আশঙ্কা করছেন না সরকারের নীতিনির্ধারকরা। ফলে ধানসহ বিভিন্ন শস্যের উৎপাদন হবে ভালো।
আগামী অর্থবছরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে না, জিনিসপত্রের দামও থাকবে স্থিতিশীল। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৭ দশমিক ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন খুব বেশি দুরূহ হবে না।
তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এতো রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার পাশাপশি জিডিপি প্রবৃদ্ধিও অর্জন কঠিন হবে।
বাজেটের আকার
প্রাথমিকভাবে আগামী (২০১৮-১৯) অর্থবছরের বাজেটের আকার হচ্ছে চার লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। টাকার অঙ্কে যা ৬৭ হাজার ৭৩৪ কোটি। চলতি (২০১৭-১৮) অর্থবছরের জন্য চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট দেয়া হয়।
রাজস্ব আদায়
আগামী (২০১৮-১৯) অর্থবছরের বাজেটে মোট রাজস্বপ্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা হবে তিন লাখ ৪০ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা, যা চলতি (২০১৭-১৮) অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি। টাকার অঙ্কে যা ৫২ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট নির্ধারিত রয়েছে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের যে টার্গেট তা আদায় হবে নতুন কোনো করারোপ ছাড়াই। করের আওতা বাড়িয়ে এ টার্গেট পূরণ হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরে মোট রাজস্বপ্রাপ্তির যে লক্ষ্যমাত্রার প্রস্তাব হচ্ছে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায়ের টার্গেট দেয়া হবে বরাবরের মতো এনবিআরকে। এনবিআরকে আগামী অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার ৮১২ কোটি টাকা। এনবিআর-বহির্ভূত খাত থেকে আগামী অর্থবছরে রাজস্বপ্রাপ্তি ধরা হচ্ছে ১১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে আট হাজার ৬২২ কোটি টাকা। আর কর-ব্যতীত প্রাপ্তি প্রাক্কলিত হচ্ছে ৩৩ হাজার ১১২ কোটি টাকা, চলতি (২০১৭-১৮) অর্থবছরে যা রয়েছে ৩১ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে। এ খাত থেকে এক লাখ ২০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হতে পারে বলে জানা গেছে।
দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজস্ব আদায়ের খাত হিসেবে রয়েছে আয় ও মুনাফার ওপর কর। এ খাত থেকে আগামী অর্থবছরে ৯৪ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, আগামী ডিসেম্বরের শেষদিকে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর আগামী অর্থবছরের বাজেট দেয়া হবে আগামী বছরের জুন মাসে। নতুন অর্থবছরের শুরুর ছয় মাস পরই নির্বাচন। তাই আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট এখন পর্যন্ত যা নির্ধারণ হয়েছে তা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৮ ভাগের চেয়ে বেশি। এটি কোনো বিশাল টার্গেট নয়, কারণ চলতি অর্থবছরের রাজস্বপ্রাপ্তির টার্গেট এর পূর্ববর্তী অর্থবছরের চেয়ে ১৮ দশমিক ৬২ ভাগ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বছর শেষে এ রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে না। রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা কম হতে পারে।
তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরে নতুন করে করারোপের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই, তাই রাজস্ব আদায় কিছুটা কমতে পারে।
সূত্র জানায়, প্রতি অর্থবছর বছরের শুরুতে বিশাল রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হলেও শেষদিকে তা কমিয়ে আনা হয়। কমিয়ে আনায় গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছে রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি
আগামী অর্থবছরে এক উচ্চাভিলাষী জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায় সরকার। এরই আলোকে আগামী (২০১৮-১৯) অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। টাকার অঙ্কে জিডিপি হবে ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে ২২ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার আশা করছে আগামী অর্থবছরে দেশে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও স্বাভাবিক থাকবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে না, জিনিসপত্রের দামও থাকবে স্থিতিশীল। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৭ দশমিক ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন খুব বেশি দুরূহ হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশের ওপরে থাকলেও এর পরের বছর আমাদের প্রক্ষেপণ হচ্ছে এ প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগে উত্তীর্ণ করা। আমাদের প্রাক্কলন অনুযায়ী (২০১৯-২০) অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৮ শতাংশ এবং এর পরের অর্থবছর (২০২০-২১) তা ৮ দশমিক ২ ভাগে নিয়ে যাওয়া। তবে এ অঙ্কে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে যেতে হলে অবশ্যই বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো করতে হবে। কারণ বিনিয়োগ না বাড়লে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব হবে না।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে বলেছিলেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির পদক্ষেপ দরকার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমাদের মোট বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ। যেখানে সরকারি খাতের বিনিয়োগ ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমরা মোট বিনিয়োগ জিডিপির ৩১ দশমকি ৯ শতাংশে উন্নীত করতে চাই। এক্ষেত্রে ব্যক্তি ও সরকারি খাতের বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ৮ দশমিক ৬ শতাংশ।
বাজেট ঘাটতি
আগামী (২০১৮-১৯) অর্থবছরের বাজেটে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে ঘাটতির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে তার পরিমাণ এক লাখ ২৭ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৩ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এক লাখ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা ধার করবে সরকার। মধ্যে ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা এবং অন্য খাতে এক হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
আগামী (২০১৮-১৯) অর্থবছরের বাজেট বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অন্য সূচক বিবেচনায় নিলে এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শুরু থেকেই আমরা তা বলি কিন্তু সরকার কানে নেয় না। তবে বছরের মাঝামাঝি সময় এসে তা সংশোধিত হয়।
তিনি আরো বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি যদি ৮ শতাংশ উন্নীত করতে হয়, তবে জিডিপির অংশ হিসেবে মোট বিনিয়োগ ৩৩ শতাংশের বেশি করতে হবে, যা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বর্ধিত আকারে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করলে দেশে অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন রয়েছে। আর সেটি করতে হলেও বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। সেই বিনিয়োগ কীভাবে জোগাড় করা হবে তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
এমইউএইচ/জেএইচ/এমএআর/আরআইপি