ভোগাচ্ছে চাল-পেঁয়াজ
শীতের সবজি ভরপুর থাকায় রাজধানীর বাজারে দামও কিছুটা কমেছে। ফলে সবজি কিনতে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। সবজিতে স্বস্তি মিললেও ভোগাচ্ছে চাল, পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচ।
বাজারে পেঁয়াজের ঝাঁজ ক্রমেই বাড়ছে। থেমে নেই মোটা চালের দামও। অথচ বাজারে ইতোমধ্যে এসেছে নতুন চাল। কিছুদিনের মধ্যেই আসবে নতুন পেঁয়াজও। এরপরও দাম না কমায় চাল, পেঁয়াজের দাম নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছেন ক্রেতারা।
মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি বলন, ভেবেছিলাম বাজরে নতুন চাল আসলে দাম কমবে। কিন্তু এখন দেখি উল্টো দাম বেড়েছে। এভাবে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকলে পরিবার নিয়ে তিন বেলা ভাত খাওয়ায় কষ্ট হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, শুধু চালের দাম নয়, এখন সবকিছুর দামই ঊর্ধ্বমুখী। বাজারে এক কেজি পেঁয়াজের দাম প্রায় দেড়শ টাকা। কাঁচামরিচের দাম তো অধিকাংশ সময় দেড়শ টাকার ওপরেই থাকছে। কিছুদিন পরেই তো বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসবে। তাহলে এখন কেন পেঁয়াজের দাম বাড়বে?
শুধু ইসমাইল হোসেনই নয়- চাল, পেঁয়াজের বাড়তি দাম ভোগাচ্ছে নিম্ন আয়ের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে।
রিকশাচালক মো. মোবারক বলেন, দুই সন্তানসহ পরিবার নিয়ে খিলগাঁওয়ের একটি টিনশেড বাসায় থাকি। প্রতিমাসে যে আয় করি তার বড় অংশই চলে যায় চাল কিনতে। গত মাসে যে চাল ৫০ টাকা কেজি কিনেছি, শনিবার (৯ ডিসেম্বর) সেই চালের কেজি ৫২ টাকা। ফলে চালের দাম বাড়ায় অনেক আগেই খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। এখন আবার দাম বাড়ছে। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে আমরা কীভাবে চলবো।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, হাওরে বন্যার প্রভাবে গত জুন থেকেই চালের দাম বাড়তি। সরকারের দৌড়-ঝাঁপের মধ্যে দাম কিছুটা কমলেও, পরবর্তীতে দম বৃদ্ধির পাল্লায় আরও হাওয়া লেগেছে। দাম বাড়তে বাড়েত গত সেপ্টেম্বরে দেশের ইতিহাসে প্রথমবার মোটা চালের কেজি ৫০ টাকা এবং সরু চাল ৬০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
চালের এমন লাগামহীন ঊর্ধ্বমুখীর কারণে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে মজুতদারির বিরুদ্ধে অভিযানে নামে সরকার। ফলে কেজিতে চালের দাম প্রায় পাঁচ টাকা করে কমে যায়। এতে ৫০ টাকার নিচে আসে মোটা চালের কেজি। তবে সরু চালের কেজি ৬০ টাকার ওপরেই থাকে।
এ অবস্থায় নভেম্বরের শেষের দিকে কৃষকের ঘরে উঠতে শুরু করে নতুন ধান। এতে চালের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় কিছুটা ছেদ পড়বে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল সাধারণ মানুষের। কিন্তু কৃষকের ঘর হয়ে নতুন ধানের চাল বাজারে আসলেও দাম কমনি। উল্টো গত সপ্তাহে দুই দফায় বেড়েছে চালের দাম।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত সপ্তাহের চেয়ে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে। ৬৪-৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া সরু চালের দাম বেড়ে হয়েছে ৬৬-৬৭ টাকা। নাজিরশাইল চালের দাম বেড়ে ৭০ টাকায় ছুয়েছে। মোটা চাল (পাইজাম/লতা) বিক্রি হচ্ছে ৫২-৫৬ টাকা কেজি দরে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন বাজারে ৭০০-৭৫০ টাকা মণ দরে ধান পাওয়া যাচ্ছে। এ দামে ধান কিনে সেই ধানের চালের দাম সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা হতে পারে। কিন্তু বাজারে সেই চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৬৬ টাকায়। একটি সিন্ডিকেটের কারণে চালের এমন বাড়তি দাম বলে অভিযোগ করেছেন খোদ ব্যবসায়ীরাই।
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের মেসার্স আল্লারদান রাইস স্টোরের সত্ত্বাধিকারী মো. জানে আলম ভূঁইয়া বলেন, বাজারে নতুন চাল এসেছে। কিন্তু গত চার-পাঁচদিনে চালের দাম দুই দফা বেড়েছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ী বস্তায় (৫০ কেজি) ৫০-১০০ টাকা, আবার কোনো কোনো ব্যবসায়ী ১০০ টাকা করে দুই দফায় ২০০ টাকা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। মিনিকেট, মোটা সব ধরনের চাল বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর তথ্যেও ওঠে এসেছে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি। টিসিবির চালের যে মূল্য তালিকা প্রকাশ করেছে তার তথ্য অনুযায়ী, এক সপ্তাহে সরু চালের দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ, সাধারণ মানের নাজির ও মিনিকেটের দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর উন্নত মানের নাজির ও মিনিকেটের দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। পাইজাম/লতা চলের দাম বেড়েছে ৪ দশমকি ৩৫ শতাংশ। আর মোটা চাল স্বর্ণ/চায়না, ইরির দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ।
আর বছরের ব্যবধানে সরু চালের দাম বেড়েছে ২১ দশমিক ৫৭ শতাংশ, সাধারণ মানের নাজির ও মিনিকেটের দাম বেড়েছে ২৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর উন্নত মানের নাজির ও মিনিকেটের দাম বেড়েছে ২৩ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। পাইজাম/লতা চলের দাম বেড়েছে ২১ দশমকি ৯৫ শতাংশ। আর মোটা চাল স্বর্ণ/চায়না, ইরির দাম বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
চালের এমন বাড়তি দামের বিষয়ে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, মিলাররা যদি দাম না কমায় তাহলে দাম বাড়তেই থাকবে। এখন সিজন, এ সময়েও ৬৫-৬৬ টাকায় চাল বিক্রির অর্থ মিল মালিকরা চালের দাম কমাচ্ছে না। আর যে দাম কমাচ্ছে না তার জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য অধিদফতর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কি তাও আমরা বুঝতে পারছি না।
তিনি বলেন, চালের ব্যবসা ১৫-২০ জনের দখলে চলে গেছে। কয়েকজন ব্যাংক থেকে ৫০০ থেকে দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ব্যাংক ঋণ নিয়ে এখন তারা এ সিজনে কম দামে ধান কিনছে। কয়েকজনের প্রত্যেক জেলায় গোডাউন আছে। ধান কিনে গোডাউনে মজুদ করছে। এরাই হলো সিন্ডিকেট। এরাই দাম বাড়ায়-কমায়।
এদিকে গত অক্টোবর থেকে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লেখায় পেঁয়াজ। সেপ্টেম্বরে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া দেশি পেঁয়াজ দাম বাড়তে বাড়েত অক্টোবরে ৮০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৮০-৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় দেশি পেঁয়াজ। কিন্তু নভেম্বরের শেষ দিকে তা ১০০ টাকা ছুয়ে ফেলে। আর চলতি সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম আর এক দফা বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে।
শান্তিনগর বাজারের ব্যবসায়ী মো. আবুল বাশার বলেন, গত সপ্তাহে এক কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ৯০ টাকায়। এখন সেই পেঁয়াজ ১২০ টাকা কেজি বিক্রি করতে হচ্ছে। শুধু দেশি পেঁয়াজ না, আমদানি করা পেঁয়াজের দামও বেড়েছে। ৭৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি করতে হচ্ছে ৮৫ টাকায়।
তিনি আরও বলেন, পাইকারদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, তাই বিক্রি করতে হচ্ছে বেশি দামে। শুনছি পেঁয়াজের দাম আরও বাড়তে পারে।
এদিকে সবজি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শীতের সবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, লাউ এখন বাজার ভরপুর। সঙ্গে করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, শাল গম, পাঁকা ও কাঁচা টমেটা সবকিছুর সরবরাহ রয়েছে পর্যাপ্ত। ফলে দামও কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।
পাকা টমেটোর কেজি ১০০ টাকা থাকলেও কাঁচা টমেটো ৩০-৪০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যাচ্ছে। একই দামে পাওয়া যাচ্ছে শিম, বেগুন, করলা। শালগম পাওয়া যাচ্ছে ২০-২৫ টাকা কেজি দরে। মুলা মিলছে ১৫ টাকায়। ২০- ২৫ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে ফুলকপি, বাঁধাকপি।
২০১৫ ও ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের দামের সঙ্গে তুলানা করে দেখা গেছে, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, লাউ, করলা, ঢেঁড়শ, বেগুন, শালগম, টমেটোর দাম চলতি বছরেও আগের দুই বছরের সমানই রয়েছে।
সবজির দাম সম্পর্কে রামপুরার গৃহিণী শিমুল আক্তার বলেন, কপি, শিমসহ অধিকাংশ শাক-সবজির দাম বেশ কমেছে। দাম কমায় শাক-সবিজ খাওয়ার পরিমাণও বেড়েছে। কিন্তু চাল আর পেঁয়াজের যে দাম, সবজির দাম কমার সব আনন্দ তাতে মাটি হয়ে যাচ্ছে। সবজি তো কম খেলেও চলে, চাল ছাড়া তো চলে না। সরকারের উচিত সবার আগে চালের দাম কমানোর উদ্যোগ নেয়া।
এমএএস/এএইচ/আরআইপি