নয় ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা
অনিয়ম, দুর্নীতি আর নানা অব্যবস্থাপনায় যাচাই-বাছাই ছাড়াই নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এসব প্রতিষ্ঠান ঋণের মান অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে গিয়ে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় পুরো হোঁচট খেয়েছে। ফলে মূলধন শূন্য হয়ে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি নয় ব্যাংকে। গত সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হয়েছে ১৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
জানা গেছে, চলতি বছর থেকে ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে ১০ শতাংশ ন্যূনতম মূলধনের পাশাপাশি দশমিক ৬২ শতাংশ হারে অতিরিক্ত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। গত সেপ্টেম্বর শেষে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে ৯ ব্যাংক। এছাড়া ব্যাংক খাতে মূলধন সংরক্ষণের হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ।
বর্তমানে ব্যাংকগুলোকে ৪০০ কোটি টাকা অথবা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের মধ্যে যা বেশি সেই পরিমাণ অর্থ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। এদিকে ঝুঁকি মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে ১০ শতাংশ ন্যূনতম মূলধনের পাশাপাশি দশমিক ৬২ শতাংশ হারে অতিরিক্ত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। গত সেপ্টেম্বর শেষে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে ওই ৯টি ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে আটটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে তিনটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, তিনটি রাষ্ট্রীয় মালিকানার বিশেষায়িত ব্যাংক এবং তিনটি বেসরকারি খাতের ব্যাংক রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক প্রথম মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে, যা উদ্বেগ বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত মিলিয়ে সরকারি খাতের ছয় ব্যাংকে ১৫ হাজার ৯০৮ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। বিশেষায়িত বেসিক ব্যাংকে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ঘাটতি ৭৪২ কোটি।
সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি রয়েছে সোনালী ব্যাংকের। এই ব্যাংকের ঘাটতি ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। এছাড়া জনতা ব্যাংকের ঘাটতি ১ হাজার ২৭৩ কোটি এবং রুপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৯০ কোটি টাকা। তবে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ও অগ্রণী ব্যাংকে কোনো মূলধন ঘাটতি নেই।
জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি তৈরি হলে বাজেট থেকে তার যোগান দিতে হয়।
জনগণের করের টাকায় বিভিন্ন সময় মূলধন ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকগুলোতে অর্থ যোগান দেয় সরকার। তবে করের টাকায় মূলধন যোগানের বিরোধিতা বরাবরই করে থাকেন অর্থনীতিবিদরা। এদিকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর বাইরে ঘাটতির তালিকায় রয়েছে বেসরকারি খাতের তিনটি ব্যাংক। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ২৩১ কোটি টাকা। এছাড়া প্রথমবারের মত নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক মুলধন ঘাটতিতে পড়েছে। ঋণ কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৫ কোটি টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। সম্প্রতি দেশের ব্যাংকিং খাতের সুদ অনেকখানি কমেছে। খেলাপি গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে পাচ্ছেন সহজ শর্তে ঋণ পুনঃতফসিল, ঋণের বাড়তি মেয়াদের সুযোগ। তবে সেসব সুবিধা পাওয়ার পরও কমেনি খেলাপি ঋণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর ২০১৬ শেষে ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। (জুন-সেপ্টেম্বর’১৭) তিন মাসে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি বেড়েছে ৬ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৭৪ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। আর সরকারি ও বেসরকারি খাতের সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণ বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতিতে পড়েছে। ফলে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অনিয়ম, আর্থিক কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি আর চরম অব্যবস্থাপনার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা আদায় করতে পারছে না। ফলে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে গিয়ে মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে এ হার বেশি।
তিনি বলেন, সরকারের উচিত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতিতে অর্থ না দিয়ে তাদের দক্ষতা ও খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে যারা ব্যর্থ হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কারণ এভাবে মূলধনের ঘাটতি মেটাতে সরকার অর্থ দিলে তারা কাজ না করে টাকা নিতে উৎসাহী হবে। আর সরকারের অর্থ মানে হলো সাধারণ জনগণের উপর দায় চাপানো। তাই আগামীতে জনগণের করের অর্থ যাতে বরাদ্দ দিতে না হয় সেই বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এসআই/ওআর/এমআরএম