এবি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার আরো অবনতি
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এবি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ধারাবাহিকভাবে অবনতি হচ্ছে। বিভিন্ন অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েও আর্থিক অবস্থার অবনতি ঠেকাতে পারছে না। বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণ। দেখা দিয়েছে নগদ অর্থের সংকট। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, অতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণে মোটা অংকের টাকা প্রভিশন রাখতে গিয়ে লোকসানের খাতায় নাম লিখিয়েছে ব্যাংকটি।
প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এবি ব্যাংকের স্থায়ী সম্পদ ও বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে। অপরদিকে বেড়েছে অন্যান্য ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এজেন্টের কাছ থেকে ধার করা অর্থের পরিমাণ। খেলাপি হয়ে পড়েছে বড় অংকের ঋণ। ফলে প্রভিশন রাখতে হয়েছে মোটা অংকের অর্থ।
এদিকে ব্যাংকের প্রধান আয়ের ক্ষেত্র ঋণ বিতরণ থেকে প্রাপ্ত সুদ আয়েও নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কমে গেছে আগের বছরের তুলনায় সুদপ্রাপ্তির পরিমাণ। এমনকী প্রতিষ্ঠানটি সুদ-বাবদ যে পরিমাণ অর্থ আয় করছে, সুদ পরিশোধেও প্রায় সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ক্যাশ-ফ্লোতে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় ব্যাংকটির ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।
ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা এতোই অবনতি হয়েছে যে, চলতি হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) লোকসানে পড়তে হয়েছে। এ তিন মাসে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয়ছে ১১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ২০১০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এমন দুরবস্থায় ব্যাংকটি আগে কখনো পড়েনি। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিক বাদ দিলে গত সাত বছরে প্রতি প্রান্তিকে এবি ব্যাংক মুনাফা করেছে।
অব্যবস্থাপনা, সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও প্রভিশন ঘাটতিসহ বিভিন্ন কারণে গত ৩ মে এবি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং পরিদর্শন বিভাগ-২ এর মহাব্যবস্থাপক শেখ মোজাফ্ফর হোসেনকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে এবি ব্যাংকের বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় চার হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল চার হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ব্যাংকটির বিনিয়োগ কমেছে ১৪১ কোটি টাকা।
প্রতিষ্ঠানটির সরকারি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমেছে। চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে সরকারি খাতে এবি ব্যাংকের বিনিয়োগ দাঁড়ায় চার হাজার ৮১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময় ছিল চার হাজার ১৯০ কোটি টাকা। আর চলতি বছর অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৪৪৪ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৪৭৬ কোটি টাকা।
এবি ব্যাংকের সম্পদের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯৫ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময় ছিল ৪০৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় স্থায়ী সম্পদ কমেছে ১৩ কোটি টাকা। শুধু আগের বছরের তুলনায় নয়, চলতি বছরের প্রথমার্ধের তুলনায়ও কোম্পানিটির স্থায়ী সম্পদ কমেছে। গত জুন শেষে ব্যাংকটির স্থায়ী সম্পদ ছিল ৪৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে স্থায়ী সম্পদ কমেছে ৬৩ কোটি টাকা।
তথ্য পর্যালোচনা করে আরো দেখা গেছে, চলতি বছর এবি ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এজেন্টের কাছ থেকে ধার করেছে দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময় ছিল এক হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাংকটির ধারের পরিমাণ বেড়েছে এক হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। ধারের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
এদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ের জন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রভিশন রেখেছে ৩৩৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে রাখতে হয়েছে ৩৩৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। আর শেষ তিন মাসের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জন্য প্রভিশন রাখতে হয়েছে ১০০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে রাখতে হয়েছে ৯৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ প্রভিশন রাখার পরিমাণ আগের বছরের নয় মাস অথবা তৃতীয় প্রান্তিক সবদিক থেকে বেশি। আগের বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকটির প্রভিশন ছিল ২০৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ায় ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে প্রভিশন বাড়িয়ে রাখতে হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকী বিষয়টি স্বীকার করেছে খোদ এবি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, একদিকে সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে যাওয়া, অন্যদিকে অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ধারের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার মানে হলো ব্যাংকটি বড় ধরনের তারল্য সংকটে ভুগছে। সম্ভবত তারা যে ঋণ বিতরণ করছে এর বড় অংশই নন-পারফর্মিং হচ্ছে, যে কারণে উত্তোলন ও ঋণ বাড়াচ্ছে এবং সরকারি সিকিউরিটিজের স্বল্প মেয়াদি বিনিয়োগ কমিয়ে আনছে।
খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে মোটা অংকের টাকা প্রভিশন রাখতে হচ্ছে- স্বীকার করে এবি ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ও কোম্পানি সচিব মহাদেব সরকার সুমন বলেন, আমাদের ক্লাসিফিকেশন লোন বেড়ে গেছে। যে কারণে প্রভিশন বাড়াতে হয়েছে। আর বড় অংকের প্রভিশন রাখার কারণে চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে লোকসান হয়েছে।
ক্যাশ-ফ্লো’র তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে এবি ব্যাংক সুদ-বাবদ গ্রহণ করেছে এক হাজার ১৪২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর বিপরীতে সুদ পরিশোধ করেছে এক হাজার ৯০ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অন্যান্য ব্যাংক ও গ্রাহকের ডিপোজিটেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে পরিচালন কার্যক্রমে ক্যাশ-ফ্লো বা নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন কার্যক্রমে ক্যাশ-ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক এক হাজার ৪৩ কোটি টাকা। অথচ এক বছর আগে প্রতিষ্ঠানটির ক্যাশ-ফ্লো ভালো অবস্থানে ছিল। ২০১৬ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে এবি ব্যাংকের পরিচালন কার্যক্রমে ক্যাশ-ফ্লো ছিল দুই হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের নয় মাসে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি নিট অপারেটিং ক্যাশ-ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১৩ টাকা ২ পয়সা। যা আগের বছরের একই সময় ছিল ধনাত্মক ৪৪ টাকা ৪৬ পয়সা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়ার অর্থ হলো ওই প্রতিষ্ঠানে নগদ অর্থের সংকট দেখা দেয়া। এতে ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে নানা সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। বিশেষ করে পাওনাদারের অর্থ পরিশোধ কষ্টকর হয়ে পড়ে। হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে অর্থের প্রয়োজন হলে তা যোগানে সমস্যা হয়। শেয়ারহোল্ডারের জন্য নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা দূরহ হয়ে পড়ে। ব্যাংকের ক্ষেত্রে আমানত গ্রহণের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেশি হওয়ায় ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক হওয়ার অন্যতম কারণ।
এ বিষয়ে এবি ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মহাদেব সরকার সুমন বলেন, ব্যাংকের ডিপোজিট (আমানত) কম আসলে এবং ঋণ বিতরণ বেশি হলে ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। আমাদের ডিপোজিট কম এসেছে, এ কারণে ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। তবে এখন আমাদের এক্সেস ডিপোজিট (অতিরিক্ত আমানত) আছে, সুতরাং এখন হিসাব করলে ক্যাশ-ফ্লো পজেটিভ হবে।
এমএএস/এমএআর/বিএ