ডিএসই এমডির বিদেশ ‘ভ্রমণপ্রীতি’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) জন্য ‘ভালোমানের কৌশলগত বিনিয়োগকারী আনা’ অন্যতম শর্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় কে এ এম মাজেদুর রহমানকে। তবে এ শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলেও একের পর এক বিদেশ ভ্রমণে সময় পার করছেন মাজেদুর রহমান। এতে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়েছে ডিএসইকে।
শুধু প্রতিষ্ঠানের এমডিই নন, বিদেশ ভ্রমণে অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের পেছনেও বড় অংকের অর্থ ঢেলেছে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকী ডিএসইর টাকায় বিদেশ ঘুরে এসেছেন শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কয়েক কর্মকর্তাও।
দায়িত্ব গ্রহণে বছর পার হলেও ডিএসইতে দৃশ্যমান গুরুত্বপূর্ণ কোনো অবদান দেখাতে পারেননি মাজেদুর রহমান। প্রতিষ্ঠানের আধুনিকায়ন, বর্তমান ট্রেডিং সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট আধুনিকায়ন, মোবাইল অ্যাপসসহ বড় বড় প্রজেক্টগুলো সম্পন্ন হয়েছে স্বপন কুমার বালা এমডি থাকা অবস্থায়।
মাজেদুর রহমানের দায়িত্ব পালনকালীন গত এক বছরে বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় বিদেশ ভ্রমণে তার পেছনে বড় অংকের অর্থ খরচ হওয়ার কথা, এমনটি মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু বর্তমান এমডির পেছনে গত এক বছরে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে, তা আগের এমডি স্বপন কুমার বালার তিন বছরে খরচ করা অর্থের প্রায় সমান।
এমডির দায়িত্ব পাবার মাত্র এক বছরেই মাজেদুর রহমানের বিদেশ ভ্রমণের পেছনে ডিএসইর খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা। আগের এমডি স্বপন কুমার বালা তিন বছরে বিদেশ ভ্রমণে খরচ করেছিলেন ৩১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।
স্টক এক্সচেঞ্জ ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন (ব্যবস্থাপনা ও মালিকানা পৃথকীকরণ) হওয়ার পর ডিএসইর দ্বিতীয় এমডি হিসেবে ২০১৬ সালের ১২ জুলাই যোগ দেন মাজেদুর রহমান। এর আগে একই বছরের ২৯ জুন ডিএসইর এমডি হিসেবে মাজেদুর রহমানের নিয়োগ অনুমোদন করে বিএসইসি।
এমডি হিসেবে যোগদানের পর ডিএসইর টাকায় মাজেদুর রহমান ইতোমধ্যে কলম্বো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, চীন ও তুরস্ক ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে সর্বশেষ গত ২৯ অক্টোবর ঢাকা থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুল সফরে যান তিনি। সপ্তাহখানেক ইস্তাম্বুলে কাটিয়ে ঢাকা ফেরেন ৫ নভেম্বর। সর্বশেষ এ ভ্রমণে মাজেদুর রহমানের পেছনে ডিএসইর কী পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে সে তথ্য পাওয়া যায়নি। কারণ এখনও এ খরচের তালিকা চূড়ান্ত হয়নি বলে জানা গেছে।
তবে তুরস্ক ভ্রমণ বাদ দিয়ে মাজেদুর রহমানের বিদেশ ভ্রমণে ডিএসইর প্রায় ২৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে কলম্বো ভ্রমণে তিনি খরচ করেছেন নয় লাখ ৯৪ হাজার টাকা। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নয় লাখ ৭৬ হাজার টাকা, ব্যাংকক ভ্রমণে প্রায় ৭০ হাজার, চীন ভ্রমণে এক লাখ ৬৮ হাজার এবং সাউথ এশিয়া ফেডারেশন অব এক্সচেঞ্জ (এসএএফই) কনফারেন্সে যোগ দেয়ার জন্য তিন লাখ ২৩ হাজার টাকা খরচ হয়েছে তার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ডিএসইর এমডি হিসেবে মাজেদুর রহমানের নিয়োগের অন্যতম শর্ত ছিল ভালোমানের কৌশলগত বিনিয়োগকারী খুঁজে আনা। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে একাধিকবার সময় বাড়ানোর পরও কৌশলগত বিনিয়োগকারী আনতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে ডিএসই।
২০১৩ সালের স্টক এক্সচেঞ্জ ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইনে ২০১৬ সালের মধ্যে কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে স্টক এক্সচেঞ্জের সংরক্ষিত ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রির বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই করারও বাধ্যবাধকতা ছিল। তবে ওই সময়ের মধ্যে কৌশলগত বিনিয়োগকারী না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফায় আরও ছয় মাস সময় বৃদ্ধি করে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় দেয় বিএসইসি। এ দফায়ও কৌশলগত বিনিয়োগকারী চূড়ান্ত করতে ব্যর্থ হয় ডিএসই। এ পরিস্থিতিতে তৃতীয় দফায় আরও ছয় মাস সময় বাড়ানো হয়েছে। তবে এবারও প্রতিষ্ঠানটি ভালোমানের কৌশলগত বিনিয়োগকারী পাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এদিকে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হয়েছে ডিএসই। যে কারণে খরচের লাগাম টেনে ধরা অন্যতম নীতি হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানটির। এতে খরচ কমাতে অনৈতিকভাবে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইন লঙ্ঘন করে ডিএসইর ২০১০ সালের বেতন কাঠামো ভেঙে দেয়। সেইসঙ্গে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি ও বেতন-ভাতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াও স্থগিত করা হয়।
কিন্তু কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে এভাবে ‘ব্যয় সংকোচন নীতি’ কার্যকর হলেও বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি ‘হাত খুলে’ অর্থ খরচ করছে। যে কারণে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের পর প্রথমবারের মতো ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশ ভ্রমণ খাতে ডিএসইর কোটি টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। গত অর্থবছরে শুধু বিদেশ ভ্রমণ খাতে প্রতিষ্ঠানটি খরচ করেছে মোট এক কোটি সাত লাখ ৯৫ হাজার টাকার বেশি।
এ খরচের মধ্যে ডিএসইর সাবেক চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সিদ্দিকুর রহমানের বিদেশ ভ্রমণে ১৫ লাখ ছয় হাজার টাকা এবং সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মুজিবুর রহমানের জন্য খরচ হয়েছে ১০ লাখ ছয় হাজার টাকা। এছাড়া বিদেশ ভ্রমণে ডিএসইর শেয়ারহোল্ডার পরিচালক শাকিল রিজভীর জন্য পাঁচ লাখ ৫৭ হাজার, রকিবুর রহমানের জন্য দুই লাখ তিন হাজার এবং মোহাম্মদ শাহজাহানের জন্য দুই লাখ তিন হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে খুশি রাখতে ডিএসইর টাকায় বিএসইসির কয়েকজন কর্মকর্তাকেও বিদেশ ভ্রমণ করানো হয়েছে। তাদের মধ্যে বিএসইসির কমিশনার হেলাল উদ্দীন নিজামীর ফিলিপাইন ভ্রমণের জন্য খরচ করা হয়েছে দুই লাখ ৫৪ হাজার টাকা। বিএসইসির ডেপুটি ডিরেক্টর হাসান মাহমুদের জন্য দুই লাখ ছয় হাজার এবং মোহাম্মদ সাইফুল আজম ও শেখ মো. লুতফুল কবিরের জন্য এক লাখ ৮৬ হাজার টাকা করে খরচ করেছে ডিএসই। বিএসইসির এই তিন ডিডিই ডিএসইর টাকায় ফিলিপাইন ভ্রমণ করেছেন।
তবে বিদেশ ভ্রমণপ্রীতি ও এ জন্য বিপুল অর্থ খরচের বিষয়ে ডিএসইর এমডি মাজেদুর রহমানের মোবাইল ফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে ডিএসইর চেয়ারম্যান ড. আবুল হাসেম জাগো নিউজকে বলেন, এমডি কেন বারবার বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছেন এবং বিদেশ ভ্রমণে কেন এতো টাকা খরচ হচ্ছে তা আমরা খতিয়ে দেখব। আর কৌশলগত বিনিয়োগকারীর জন্য এখনো সময় আছে। আমরা আশা করছি ভালো কিছু হবে।
এমএএস/এসআর/এমএআর/বিএ