বন্ধ হচ্ছে সোনালী ব্যাংক ইউকে
অনিয়ম-দুর্নীতি এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যর্থতার কারণে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের সব কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে যুক্তরাজ্যের (ইউকে) প্রডেন্সিয়াল রেগুলেশন অথরিটি। অন্যথায় ব্যাংকটির কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে একজন বিদেশি প্রজেক্ট ম্যানেজার নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছে তারা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আবু ফরাহ মো. নাছের স্বাক্ষরিত চিঠি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব ইউনূসুর রহমানের কাছে পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে এসব বিষয়ে উল্লেখ রায়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের উইন্ডিং ডাউন (গুটিয়ে নেয়া) এর সিদ্ধান্ত যদি সরকারি পর্যায়ে গৃহীত না হয় তবে যুক্তরাজ্যের প্রডেন্সিয়াল রেগুলেশন অথরিটির পরামর্শ অনুযায়ী, একজন বিদেশি প্রকল্প ব্যবস্থাপক নিয়োগ দিতে হবে। ওই প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানটির কার্যকম স্বাভাবিক করতে সম্ভাব্য পরিকল্পনা তৈরি করবেন এবং প্রডেন্সিয়াল রেগুলেশন অথরিটিকে অবহিত রাখবেন।
প্রডেন্সিয়াল রেগুলেশন অথরিটির নির্দেশনা পরিপালন করা হলে তারা সন্তুষ্ট হতে পারে যা সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের জন্য অনুকূল হতে পারে। চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে আরও বলা হয়, উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে প্রডেন্সিয়াল রেগুলেশন অথরিটি এবং যুক্তরাজ্যের ফিন্যান্সিয়াল কনডাক্ট অথরিটি (এফসিএ) এর সঙ্গে এ মুহুর্তে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে না মর্মে প্রতীয়মান হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের বিষয়ে প্রডেন্সিয়াল রেগুলেশন অথরিটি যথার্থ ভূমিকা নিয়েছে। সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডও নানান ধরনের অনিয়ম করেছে। সুতরাং এটিকে বন্ধ করে দেয়াই উচিত। এ ব্যাংকে বিদেশি প্রকল্প ব্যবস্থাপক নিয়োগ দিয়ে কোনো লাভ হবে না বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংক ইউকে-এর কার্যক্রম নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিব্রত। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কার্যক্রম বন্ধের বিকল্প হিসেবে একজন বিদেশি প্রজেক্ট ম্যানেজার নিয়োগ করা যায় কিনা-সে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যর্থতার দায়ে বড় অঙ্কের জরিমানার পর এবার সোনালী ব্যাংক ইউকের ক্লিয়ারিং কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই ব্যাংকে বাংলাদেশি যেসব ব্যাংকের 'নস্ট্রো' অ্যাকাউন্ট ছিল তা বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া শর্ত পালনে ব্যর্থ হওয়ায় সম্প্রতি এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স আহরণ ও ঋণপত্রের নিশ্চয়তা দিতে ২০০১ সালে আলাদা কোম্পানি খুলে যুক্তরাজ্যে যাত্রা শুরু করে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেড। এর ছয়টি শাখা খোলা হলেও এরই মধ্যে চারটি বন্ধ হয়ে গেছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ায় গত বছরের অক্টোবরে সোনালী ব্যাংক ইউকে ৩১ কোটি টাকা সমপরিমাণ প্রায় ৩৩ লাখ পাউন্ড জরিমানা করে যুক্তরাজ্যের ফিন্যান্সিয়াল কনডাক্ট অথরিটি (এফসিএ)।
একই সঙ্গে ১৬৮ দিন নতুন গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। উদ্ভূত এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সোনালী ব্যাংক ইউকে পরিচালনা পর্ষদের জরুরি সভা করেছে। সোনালী ব্যাংক ইউকের পর্ষদ সদস্য হিসেবে সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল-মাসুদ বর্তমানে যুক্তরাজ্য সফরে আছেন। তিনি দেশে ফেরার পর প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে তা জানা যাবে।
নানা কারণে লোকসানে পড়ায় এবং নিয়ম মেনে মূলধন বৃদ্ধির প্রয়োজনে গত এপ্রিলে সোনালী ব্যাংক ইউকে সাড়ে তিনশ' কোটি টাকা (৩ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড) জোগান পায়। এর মধ্যে মালিকানার ভিত্তিতে সরকার ১৭৮ কোটি এবং ব্যাংক দিয়েছে ১৭১ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক ইউকেতে সরকারের ৫১ ও সোনালী ব্যাংকের ৪৯ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। কার্যক্রম পরিচালনার শুরুতে আড়াই কোটি পাউন্ড মূলধন জোগান দেয়া হয়েছিল।
সংশ্নিষ্টরা জানান, রেমিট্যান্স আহরণের পাশাপাশি সোনালী ব্যাংক ইউকে 'নস্ট্রো' অ্যাকাউন্ট খুলে ডলার, ইউরো ও ব্রিটিশ পাউন্ড- এই তিন ধরনের মুদ্রায় ক্লিয়ারিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারত। বাংলাদেশি অনেক ব্যাংক এসব মুদ্রায় ব্যাংকটিতে অ্যাকাউন্ট খুলে যুক্তরাজ্যে এলসিসহ বিভিন্ন দেনা পরিশোধ করে আসছিল।
বিশেষত, এখানকার সরকারি ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ দায় পরিশোধ হত এই ব্যাংকের মাধ্যমে। তবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের সিদ্ধান্তের পর গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রথমে সাময়িকভাবে সব অ্যাকাউন্টের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। পরে চূড়ান্তভাবে এসব অ্যাকাউন্ট বন্ধের বিষয়ে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো এখন বিকল্প চ্যানেল তথা এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, মাশরেক, সিটি ব্যাংক এনএ, আল-রাজী ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন ব্যাংকে খোলা নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে লেনদেন করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে কড়াকড়ি আরোপের পর শুধু গত বছরই বন্ধ করা হয়েছে তিনটি শাখা। এর মধ্যে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর বন্ধ করা হয় ব্র্যাডফোর্ড শাখা। এর আগে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর কেমডেন এবং ৩০ জুন লুটন শাখা বন্ধ করা হয়। ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর বন্ধ করা হয়েছিল ওল্ডহ্যাম শাখা।
মূলত ২০১৩ সালের জুনে এই শাখা থেকে দুই লাখ ৫০ হাজার ডলার লুট করেন তৎকালীন ব্যবস্থাপক ইকবাল আহেমদ। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের লোকসানে পড়ে এই শাখাটি বন্ধ হয়। বর্তমানে চালু রয়েছে বার্মিংহাম ও লন্ডনের প্রধান শাখা।
এমইউএইচ/এআরএস/আরআইপি/আইআই