রোহিঙ্গা সঙ্কট : প্রতি মাসে বাড়তি ব্যয় সাড়ে ৪শ কোটি টাকা
মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে বাংলাদেশে। এসব রোহিঙ্গার ভরণ-পোষণে বাংলাদেশকে বেগ পেতে হবে। কেননা ইতোমধ্যে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
এমনিতেই দীর্ঘকাল ধরে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছিল বাংলাদেশে। নতুন করে আরও যুক্ত হচ্ছে। এসব রোহিঙ্গার পুনর্বাসনে প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে ৪শ কোটি টাকা লাগবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ সংখ্যা বাড়লে ব্যয় আরও বাড়তে পারে।
দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরবর্তী সময়ে চালের বাজারে কিছুটা প্রভাব পড়ে। রোহিঙ্গাদের আগমনে সেই চালের বাজারে আগুন লেগেছে। বাজারে গরিবের মোটা চালের দাম বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। তার মানে ৫০ টাকার কমে কোনো চাল নেই বাজারে। সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও কোনো কাজে আসছে না।
জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের পরপরই রোহিঙ্গা সংকট শুরু হয়। আশির দশকের পর বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, এই দফায় রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। মাত্র এক মাসেই টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ঢুকেছে প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। বাংলাদেশে প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থী আশ্রয় দেয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। আবার পর্যাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যও পাওয়া যাচ্ছে না। এতে বাড়তি
চাপ পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জাকির হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, নতুন করে আশ্রয় নেয়া প্রায় তিন লাখ ৭০ হাজার শরণার্থীর জন্য এখনই সরকারকে মাসে অতিরিক্ত প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার জোগান দিতে হবে। এর বাইরে এসব শরণার্থীর জন্য গৃহ ও সুপেয় পানির (গভীর নলকূপ স্থাপন) ব্যবস্থা করতে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর বাইরে চিকিৎসা, শরণার্থীর ওপর সতর্ক নজরদারি ও নিবন্ধনসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ডের জন্যও বেশ বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় হবে বলেও জানান তিনি।
শনিবার জাতিসংঘের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন থেকে দুই লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এই রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশের ৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা মন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল জাগো নিউজকে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমার স্বাধীনতার কিছুদিন পরই শুরু হয়। ওই সময় প্রায় ৩ লাখ লোক বাংলাদেশে এসেছিল, পরবর্তীতে ২ লাখের বেশি ফেরত গেছে। এখন যারা এসেছেন, তাদেরও ফেরত পাঠানো হবে। তবে এই সময় তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা যেন দেয়া যায় সে বিষয়ে সরকার সচেতন আছে।
তিনি বলেন, আশ্রিত রোহিঙ্গা ইস্যু জাতিসংঘের কাছে জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়। যতদিন এই সমস্যার সমাধান না হবে, ততদিন যেন তাদের আর্থিক সহায়তা দেয়া হয় সে বিষয়টিও জাতিসংঘের দেখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
পরিকল্পনা মন্ত্রী আরও বলেন, রোহিঙ্গারা তাদের দেশের সমস্যার কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। সেটা মানবিক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। সরকার মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে স্থান দিয়েছে। তবে দীর্ঘ সময় থাকলে তার একটা বড় প্রভাব
পড়তে পারে।
জানা গেছে, দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি, অতিবৃষ্টিতে সড়ক-রেলপথসহ নানা ধরনের অবকাঠামো খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া নষ্ট হয়েছে ফসল। সরকারের হিসেব অনুসারে, এবার চালের উৎপাদন কমবে প্রায় ৮ লাখ টন। কিন্তু কোন সংকট যেন
না হয়, সেজন্য বিদেশ থেকে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির পথ বেছে নিতে হয়েছে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাতীয় কোনো পরিকল্পনা না থাকায় আর্থিকভাবে নতুন করে সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রোহিঙ্গা প্রবেশের ফলে দেশের জনমিতির ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলবে। এরা কোনো ধরনের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে না পারায় দেশের মাথাপিছু আয়ে আরও বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হলে দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। বর্তমানে চালের দাম বাড়ার পেছনে রোহিঙ্গা সমস্যার সম্পর্ক রয়েছে। তাদের পুনর্বাসনে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।
তিনি বলেন, বর্তমানে খাদ্য ছাড়াও রোহিঙ্গাদের বাসস্থান, চিকিৎসা ও পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যাও প্রকট। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থাকে সম্পৃক্ত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে যে সাহায্য আসছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। তুরস্ক থেকে কিছু এসেছে, আবুধাবি ও মালয়েশিয়া থেকে কিছু সাহায্য এলেও চাহিদার
তুলনায় কম। এজন্য আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
এমএ/ওআর/আরআইপি