শেয়ারবাজারে ফের ব্যাংকের দাপট
পোশাক খাতকে হটিয়ে আবারও শেয়ারবাজারের লেনদেনে শীর্ষ স্থান দখল করেছে ব্যাংক খাত। আগস্ট মাসে এ খাতের কোম্পানিগুলো অনেকটাই একতরফা দাপট দেখিয়েছে। মোট লেনদেনের প্রায় ২৬ শতাংশই রয়েছে ব্যাংকের দখলে। ২০১০ সালের পর এবারই শেয়ারবাজারে এমন একতরফা দাপট দেখাল ব্যাংক খাত।
ব্যাংক খাতের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ায় সার্বিক শেয়ারবাজারেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই মোটা অংকের লেনদেন হচ্ছে। আগস্ট মাসজুড়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ২১ কার্যদিবস লেনদেন হয়েছে। প্রতি কার্যদিবসে ৯৩২ কোটি ৮২ লাখ টাকা গড়ে মোট লেনদেন হয়েছে ১৯ হাজার ৫৮৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
আগের মাস জুলাইয়ে লেনদেন হয় ২২ কার্যদিবস। মাসটিতে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ৯৫১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা হিসেবে মোট লেনদেন হয় ২০ হাজার ৯২৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। সে হিসাবে আগস্টে আগের মাসের তুলনায় লেনদেন কম হয়েছে এক হাজার ৩৪০ কোটি ২২ লাখ টাকা।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকে শেয়ারবাজারে ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের লেনদেন বাড়তে থাকে। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয় ৩৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকের শেয়ারের অংশ পাঁচ হাজার আট কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। পরের মাস ফেব্রুয়ারিজুড়ে লেনদেন হয় ১৯ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকের শেয়ারের অংশ ছিল দুই হাজার ৩৬২ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ।
জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে ব্যাংক খাতের শেয়ারের বড় অংকের লেনদেন হলেও ওই দুই মাসে লেনদেনের শীর্ষ ছিল প্রকৌশল ও ওষুধ খাত। তবে মার্চে এসে লেনদেনের শীর্ষ স্থান দখল করে ব্যাংক খাত। মার্চ মাসে এ খাতের শেয়ারের লেনদেনের পরিমাণ ছিল চার হাজার ৭১৬ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ২১ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
মার্চের ধারাবাহিকতায় এপ্রিলেও শীর্ষ স্থান ধরে রাখে শেয়ারবাজারের প্রাণ হিসেবে বিবেচিত এ খাত। এপ্রিলে ব্যাংক খাতের শেয়ারের লেনদেন হয় দুই হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা, যা ডিএসই’র মোট লেনদেনের ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ।
এরপর মে, জুন ও জুলাই টানা তিন মাস ব্যাংক খাতকে হটিয়ে শীর্ষ স্থান দখল করে পোশাক খাত। তবে আগস্ট মাসে আবারও শীর্ষ স্থানে ফিরে আসে ব্যাংক খাত। মাসজুড়ে ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন হয়েছে পাঁচ হাজার ৬০ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ২৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
আগের মাস জুলাইয়ে ব্যাংক খাতের কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয় তিন হাজার ৩২৪ কোটি টাকা, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর আগে জুন মাসে ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন হয় এক হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা, যা মাসটির মোট লেনদেনের ১৪ দশমিক ৫২ শতাংশ।
২০১০ সালেও শেয়ারবাজারে ব্যাংক খাতের এমন দাপট ছিল। শেয়ারবাজারের মহাধস ও ব্যাংক খাতের নানা কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর ব্যাংকের দাপট কমতে থাকে। মূলত ২০১২ সালের পর থেকে লেনদেনে ব্যাংক খাতের অবদান কমে যায়। ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চের আগ পর্যন্ত লেনদেনের শীর্ষস্থান প্রকৌশল, ওষুধ অথবা জ্বালানি খাতের দখলে থাকে।
২০১০ সালে মোট লেনদেনে ব্যাংক খাতের অবদান ছিল ২৭ শতাংশের ওপরে। ২০১১ সালে ডিএসই’র মোট লেনদেনে ব্যাংক খাতের অবদান ছিল ২৫ শতাংশ। ২০১২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২২ শতাংশে। এরপর তা আরও কমে ২০১৩ সালে ১৫ শতাংশ, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ১০ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ৮ শতাংশে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ দরপতনের কারণে ব্যাংক খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম অনেক কমে গিয়েছিল। চলতি বছরের প্রথমার্ধে অধিকাংশ ব্যাংকই ভালো মুনাফা করেছে। ২০১৬ সালেও অধিকাংশ ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দেয়। এ কারণে হয় তো ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়েছে। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ায় ব্যাংকের শেয়ারের লেনদেনও বেড়েছে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ফান্ডামেন্টাল অবস্থা বেশ ভালো। এ খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়া ভালো লক্ষণ। শেয়ারবাজারের লেনদেন চিত্র পর্যাবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, চলতি বছরজুড়েই ব্যাংক খাতের কোম্পানিগুলোর ভালো লেনদেন হচ্ছে। এ খাতের লেনদেনের ইতিবাচক প্রভাব সার্বিক শেয়ারবাজারেও পড়েছে। ফলে বছরের আটটি মাসেই বড় অংকের লেনদেন হয়েছে।
এ দিকে আগস্ট মাসে শেয়ারবাজারের খাত ভিত্তিক লেনদেন চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাসটিতে লেনদেনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে প্রকৌশল খাত। মাসজুড়ে এ খাতের শেয়ার লেনদেন হয় দুই হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ১৫ দশমকি শূন্য ৪ শতাংশ। আগের মাসে এ খাতের শেয়ার লেনদেন হয় দুই হাজার ৩০৮ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ১১ দশমকি শূন্য ৩ শতাংশ।
আগস্টে তৃতীয় স্থানে থাকা বস্ত্র খাতের শেয়ার লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা, যা ডিএসই’র মোট লেনদেনের ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ। জুলাই মাসে এ খাতের লেনদেনের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৩২৪ কোটি টাকা, যা ওই মাসের মোট লেনদেনের ১৫ দশমকি ৮৯ শতাংশ।
চতুর্থ স্থানে রয়েছে ওষুধ খাত। আগস্ট মাসজুড়ে এ খাতের লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা, যা ডিএসই’র মোট লেনদেনের ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। জুলাই মাসে এ খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের লেনদেনের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২৯১ কোটি টাকা, যা মাসটির মোট লেনদেনের ১০ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
এরপরের স্থানে রয়েছে আর্থিক খাত। আগস্টে এ খাতের মোট শেয়ার লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৬২২ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ। জুলাই মাসে আর্থিক খাতের শেয়ার লেনদেন হয় দুই হাজার দুই কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
লেনদেনের ক্ষেত্রে আগস্ট মাসে বাকি খাতগুলোর মধ্যে শুধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অবদান ৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। বাকি সব খাতের অবদান পাঁচ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে দুই শতাংশের ওপরে আছে পাঁচটি খাত এবং নয়টি খাতের অবদানই রয়েছে দুই শতাংশের নিচে।
আগস্টে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ার জুলাই মাসজুড়ে লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৬৮ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ৭৮৬ কোটি টাকা বা ৪ দশমকি শূন্য দুই শতাংশ অবদান রেখে এর পরের স্থানে রয়েছে খাদ্য খাত।
এছাড়া আগস্ট মাসজুড়ে বিবিধ খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। চামড়া খাতের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৫০৬ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর লেনদেন হয়েছে ৪৮৯ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ২ দশমিক ৫০ শতাংশ। ৪৭২ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে আইটি খাতের, যা মোট লেনদেনের ২ দশমিক ৪১ শতাংশ।
এছাড়া আগস্ট মাসে সিমেন্ট খাতের লেনদেন হয়েছে ১ দশমকি ৮২ শতাংশ, সেবা ও আবাসনের ১ দশমিক ৮১ শতাংশ, সিরামিকের ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ভ্রমণের ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, বীমার ১ দশমিক ১৮ শতাংশ, টেলিযোগাযোগ খাতের দশমিক ৭০ শতাংশ, পাটের দশমকি ৫০ শতাংশ, কাগজ ও মুদ্রণের দশমিক ৩২ শতাংশ এবং বন্ডের দশমিক শূন্য এক শতাংশ।
এমএএস/এমএআর/এআরএস/এমএস