ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

সঙ্কটে এবি ব্যাংক

সাঈদ শিপন | প্রকাশিত: ০৮:২০ এএম, ২২ আগস্ট ২০১৭

অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় ডুবতে বসেছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এবি ব্যাংক। অব্যবস্থাপনা, সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও প্রভিশন ঘাটতিসহ বিভিন্ন কারণে ইতোমধ্যে প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও থামছে না প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থার অবনতি। দেখা দিয়েছে নগদ অর্থের সঙ্কট।

প্রতিষ্ঠানটিতে এতোটাই সঙ্কট দেখা দিয়েছে যে, বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) তারিখ ঘোষণা করেও তা বাতিল করতে হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এবি ব্যাংকের স্থায়ী সম্পদ ও বিনিয়োগের পরিমাণ কমে গেছে। অপরদিকে বেড়ে গেছে অন্য ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এজেন্টের কাছ থেকে ধার করা অর্থের পরিমাণ। খেলাপি হয়ে পড়েছে বড় অঙ্কের ঋণ। ফলে প্রভিশন রাখতে হয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ। এতে কমে গেছে মুনাফার পরিমাণও।

এদিকে ব্যাংকের প্রধান আয়ের ক্ষেত্র ঋণ বিতরণ থেকে প্রাপ্ত সুদ আয়েও নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কমে গেছে আগের বছরের তুলনায় সুদপ্রাপ্তির পরিমাণ। এমনকি প্রতিষ্ঠানটি সুদ বাবদ যে পরিমাণ আয় করছে, সুদ পরিশোধেও প্রায় সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ক্যাশ ফ্লোতে। ব্যাংকটির ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, একদিকে অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ধারের পরিমাণ বেড়েছে, অন্যদিকে সরকারি খাতে যে বিনিয়োগ ছিল তা কমেছে। এর মানে হলো ব্যাংকটি বড় ধরনের তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। একদিকে তারা উত্তোলন বাড়াচ্ছে, ঋণ বাড়াচ্ছে, অপরদিকে সরকারি সিকিউরিটিজে স্বল্প মেয়াদি যে বিনিয়োগ ছিল, সেটি কমিয়ে আনা হচ্ছে। কারণ তাদের মূল অ্যাসেট লোন অ্যান্ড অ্যাডভান্স’র বড় অংশই সম্ভাবত নন-পারফর্মিং (খেলাপি) হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, সুদপ্রাপ্তি ও সুদ পরিশোধ প্রায় সমান হওয়া ব্যাংকের দুরাবস্থার একটি দিক। এটি ব্যাংকের খারাপ ও দুর্বল সম্পদ ব্যবস্থাপনাই নির্দেশ করে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম অর্ধ (জানুয়ারি-জুন) শেষে এবি ব্যাংকের বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৪০১ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল চার হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ব্যাংকটির বিনিয়োগ কমেছে ৩৫৫ কোটি টাকা।

প্রতিষ্ঠানটির সরকারি ও অন্যান্য উভয় ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ কমেছে। চলতি বছরের প্রথম অর্ধ শেষে সরকারি খাতে এবি ব্যাংকের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল চার হাজার ১৯০ কোটি টাকা। আর চলতি বছরে অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৫৪৬ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৫৬৫ কোটি টাকা।

এবি ব্যাংকের সম্পদের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম অর্ধ শেষে প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫৮ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪৬৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় স্থায়ী সম্পদ কমেছে ১০ কোটি টাকা।

দায়ের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে এবি ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এজেন্টের কাছ থেকে ধার করেছে দুই হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এবি ব্যাংকের ধার করার পরিমাণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

এদিকে ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে প্রতিষ্ঠানটি প্রভিশন রেখেছে ২৩৭ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১০৫ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ার কারণে ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে প্রভিশন বাড়িয়ে রাখতে হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

খেলাপি ঋণের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের জুন শেষে এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ৫৬ কোটি টাকা আদায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক হাজার ১১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৬৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০১ কোটি টাকা এবং আদায় অযোগ্য ঋণ বেড়েছে ১৯২ কোটি টাকা।

বড়ে অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়া এবং ঋণের বিপরীতে মোটা অঙ্কের প্রভিশন রাখতে গিয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মুনাফায়। চলতি বছরের প্রথম অর্ধ শেষে এবি ব্যাংকের কর পরবর্তী মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৯ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় মুনাফা ৪০ কোটি টাকা কমে প্রায় অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। ফলে আগের বছর যেখানে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি আয় ছিল এক টাকা ৪৬ পয়সা, তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৯ পয়সায়।

ক্যাশ ফ্লো’র তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে এবি ব্যাংক সুদ বাবদ গ্রহণ করেছে ৮৪৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সুদ পরিশোধ করেছে ৮৩৩ কোটি টাকা। আবার অন্য ব্যাংক এবং গ্রাহকের ডিপোজিটেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে পরিচালন কার্যক্রমে ক্যাশ ফ্লো বা নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।

২০১৬ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ে এবি ব্যাংকের পরিচালন কার্যক্রমে ক্যাশ ফ্লো ছিল দুই হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। যা চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৮৯০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের প্রথম অর্ধ শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার প্রতি নিট পরিচালন নগদ প্রবাহ ৩৫ টাকা ৬৯ পয়সা। যা চলতি বছরের প্রথম অর্ধ শেষে দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১৩ টাকা ২১ পয়সা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়ার অর্থ হলো ওই প্রতিষ্ঠানটিতে নগদ অর্থের সঙ্কট দেখা দেয়া। এতে ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। বিশেষ করে পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে অর্থের প্রয়োজন হলে তা যোগানে সমস্যার সৃষ্টি হয়। শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা দুরূহ হয়ে পড়ে।

এদিকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)-সহ একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মুঠোফোন অপারেটর প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম বা সিটিসেলকে অর্থ আত্মসাতে সহায়তার অভিযোগে গত ২৮ জুন রাজধানীর বনানী মডেল থানায় মামলা দায়ের করে দুদক।

এবি ব্যাংক ও সিটিসেলের ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। এর মধ্যে এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), প্রধান আর্থিক কর্মকর্তাসহ (সিএফও) সাবেক-বর্তমান ১২ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়। দুদকের মামলায় সিটিসেলের নামে এবি ব্যাংকের গ্যারান্টি নিয়ে আটটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অনিয়মের মাধ্যমে ৩৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়।

এ মামলায় বেশকিছুদিন পলাতক থেকে সম্প্রতি আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মসিউর রহমান চৌধুরী। তবে জামিন নেয়ার আগে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ কয়েকজন কর্মকর্তা পলাতক থাকায় ব্যাংকটির কার্যক্রমে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে আসে।

অব্যবস্থাপনা, সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও প্রভিশন ঘাটতিসহ বিভিন্ন কারণে গত ৩ মে এবি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং পরিদর্শন বিভাগ-২-এর মহাব্যবস্থাপক শেখ মোজাফফর হোসেনকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়।

এসব অনিয়মের বিষয়ে মোবাইল ফোনে এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওয়াহিদুল হক’র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমার সব ফিগার মুখস্থ নেই। তাই এসব বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।

এবি ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ও কোম্পানি সচিব মাহাদেব সরকার সুমোন বলেন, আমরা তারল্য সঙ্কটে ভুগছি, এটা সত্য নয়। তবে আমাদের খেলাপি ঋণ বেড়েছে, এটা ঠিক। এজন্য আমরা প্রভিশনও করেছি।

বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের ব্যালেন্স সিট অনুমোদন করেনি বলে আমরা এজিএম করতে পারিনি- এ কথাও সত্য না। তবে কী কারণে এজিএম’র তারিখ ঘোষণা করেও তা বাতিল করা হয়েছে- সেই বিষয়ে তিনি কিছু জানাননি।

এমএএস/এমএআর/আরআইপি

আরও পড়ুন