শেয়ারবাজারের লেনদেনে পোশাক খাতের চমক
রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিলেও দেশের শেয়ারবাজারে লেনদেনের ক্ষেত্রে চমক দেখাচ্ছে পোশাক খাত। টানা তিন মাস এ খাতটি লেনদেনে শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে এবং প্রতি মাসেই ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে পোশাক খাতের কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন। এর আগে কখনও শেয়ারবাজারে পোশাক খাতের এমন একতরফা দাপট দেখা যায়নি।
গত মে মাস থেকে শেয়ারবাজারে লেনদেনের ক্ষেত্রে দাপট দেখাতে থাকে পোশাক খাতের কোম্পানিগুলো। ফলে ২০১৩ সালের পর চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিলে লেনদেনের শীর্ষ স্থান দখল করা ব্যাংক খাতকে আবারও শীর্ষ স্থান হারাতে হয়। মে মাসে লেনদেনের শীর্ষ স্থান দখল করার পর জুন ও জুলাইয়েও লেনদেনে পোশাক খাতের কোম্পানিগুলোর দাপট অব্যাহত থাকে। জুনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মোট লেনদেনের ১৯ শতাংশই ছিল পোশাক খাতের। মে মাসে মোট লেনদেনে পোশাক খাতের অবদান ছিল ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আর সদ্য সমাপ্ত জুলাইয়ে মোট লেনদেনে পোশাক খাতের অবদান প্রায় ১৬ শতাংশ।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, জুলাই মাসে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২০ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা। জুনে লেনদেন হয় ১০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে জুলাইয়ে লেনদেন আগের মাসের তুলনায় বেড়েছে ১০ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ জুনের তুলনায় জুলাইয়ে লেনদেন দ্বিগুণ বেড়েছে। ডিএসইর খাতওয়ারি লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, লেনদেনে শীর্ষ স্থান দখল করা পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার জুলাইয়ে লেনদেন হয়েছে ৩ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৫ দশমকি ৮৯ শতাংশ।
আগের মাস জুনে এ খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ার লেনদেন হয় ১ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ১৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। তার আগের মাস অর্থাৎ মে মাসে পোশাক খাতের শেয়ার লেনদেন হয় ১ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এ চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, গত তিন মাস টানা লেনদেনের শীর্ষ স্থান দখল করার পাশাপাশি প্রতি মাসেই পোশাক খাতের কোম্পানির শেয়ার লেনদেন আগের মাসের তুলনায় বেড়েছে। আর দুই মাসের ব্যবধানে পোশাক খাতের শেয়ারের মোট লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণ।
এদিকে পোশাক রফতানিকারকরা বলছেন, বর্তমানে দেশের পোশাক খাত বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ১৫ বছরের মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পোশাক রফতানি আয়ে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। অর্থবছরটিতে পোশাক রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র দশমিক ২০ শতাংশ। যেখানে বিগত ১০ বছরে গড় অর্জিত প্রবৃদ্ধি ১৩ শতাংশের ওপরে। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পোশাক রফতানি আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হয়েছে ৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা গুজবে, হুজুগে বিনিয়োগ করে। বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে বিনিয়োগ করে না। তিনি আরও বলেন, যখন একটি খাতের রফতানি আয় কমবে এবং ব্যবসা পরিচালনা করে কম মুনাফা হবে তখন স্বাভাবিকভাবেই ওই খাতের কোম্পানিগুলোর ওপর এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যার সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। কারণ গুজবের ওপর শেয়ারবাজার চলে এবং গুজব ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীরা লাভ করতে চায়।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বর্তমানে নানা রকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পোশাক শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিগত ১৫ বছরের মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রফতানি আয়ে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আবার নতুন বাজারে যেখানে বিগত বছরগুলোতে ১৫-২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতো, সেখানে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ রফতানি আয় কমেছে। এ পরিস্থিতিতে মরার ওপর খাড়ার ঘা’র মতো সামনে এসেছে চট্টগ্রাম বন্দর সংকট।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি রফতানি কন্টেইনার না নিয়েই জাহাজ বন্দর ছেড়েছে এমন ঘটনাও ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বিদেশি ক্রেতারাও সময়মতো পোশাক পাবেন না। আর এর মাশুল দিতে হবে রফতানিকারকদের। ক্রেতারা ভারত, ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া ও মিয়ানমারের মতো দেশে তাদের অর্ডার সরিয়ে নিতে পারে।
এদিকে জুলাইয়ে শেয়ারবাজারের খাতভিত্তিক লেনদেন চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাসটিতে লেনদেনে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে ব্যাংক খাত। চলতি বছরের শুরু থেকে এ খাতটিও মোট লেনদেনে বড় অবদান রাখছে। জুলাইয়ে ব্যাংক খাতের কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। জুনে ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন হয় ১ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা, যা মাসটির মোট লেনদেনের ১৪ দশমিক ৫২ শতাংশ।
জুলাইয়ে লেনদেনে তৃতীয় স্থান দখল করেছে প্রকৌশল খাত। মাসটিতে এ খাতের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। জুনে এ খাতের লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা, যা ওই মাসের মোট লেনদেনের ৮ দশমকি ৯৫ শতাংশ।
চতুর্থ স্থানে রয়েছে ওষুধ খাত। জুলাইয়ে এ খাতের লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ২৯১ কোটি টাকা, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১০ দশমিক ৯৫ শতাংশ। জুনে এ খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা, যা মাসটির মোট লেনদেনের ১৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। লেনদেনের ক্ষেত্রে জুলাইয়ে বাকি সবকটি খাতের অবদান ১০ শতাংশের নিচে। এরমধ্যে পাঁচ শতাংশের ওপরে আছে মাত্র দুটি খাতের অবদান। আর এক শতাংশের ঘরে বা এক শতাংশের নিচে অবদান রয়েছে নয়টি খাতের। পাঁচ শতাংশের ওপরে অবদান থাকা দুটি খাতের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ার জুলাইয়ে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৮৪ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ২ হাজার ২ কোটি টাকা বা ৯ দশমকি ৫৭ শতাংশ অবদান রেখে এর পরের স্থানেই রয়েছে আর্থিক খাত।
এছাড়া জুলাইয়ে খাদ্য খাতের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৯৭০ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। বিবিধ খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৮৯৪ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। আইটি খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৭০৬ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ। সিমেন্ট খাতের লেনদেন হয়েছে ৬৩৫ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। ৫১৪ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে টেলিযোগাযোগ খাতের, যা মোট লেনদেনের ২ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এছাড়া জুলাইয়ে সেবা ও আবাসনে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ, ভ্রমণের ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ, বীমার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ, চামড়ার ১ দশমিক ২২ শতাংশ, সিরামিকের ১ দশমিক ১১ শতাংশ, কাগজ ও মুদ্রণের দশমিক ৩৫ শতাংশ, পাটের দশমিক ১৮ শতাংশ এবং বন্ডের দশমিক শূন্য এক শতাংশ লেনদেন হয়েছে ।
এমএএস/জেএইচ/ওআর/জেআইএম