খেলাপির সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকা আদায় কঠিন
অনিয়ম, জালিয়াতি ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে এ খাতে বেড়েছে মন্দ ঋণ বা নন-পারফর্মিং লোনের (এনপিএল) পরিমাণ। ২০১৬ সাল শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫২ হাজার ৪৭১ কোটি টাকাই মন্দ বা কু-ঋণ, যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৪ দশমিক ৪ শতাংশ। মন্দ ঋণের অর্থ আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম বলে ধরে নেয়া হয়।
সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট- ২০১৬ প্রকাশিত হয়। ওই রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ব্যাংকগুলো ছয় লাখ ৭৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করে। ওই ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৬২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ২ শতাংশ।
খাত ভিত্তিক হিসেবে এককভাবে গত বছর সবচেয়ে বেশি ঋণ পেয়েছে বাণিজ্যিক খাত। এ খাতে ঋণ দেয়া হয়েছে এক লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণও সবচেয়ে বেশি। এ খাতে খেলাপি ঋণ ১৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা বা মোট খেলাপির ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ ঋণ পেয়েছে বড় শিল্পপতিরা। ওই বছরে নেয়া এক লাখ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ছয় হাজার ১১০ কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ রয়েছে বড় বড় শিল্পে।
দেশের শীর্ষ রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পও ব্যাংক ঋণের শীর্ষ সুবিধাভোগী। গত বছর ৭৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা ঋণ এ খাতকে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। যা মোট ঋণের ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া মোট খেলাপির ১২ দশমিক ৬ শতাংশ বা সাত হাজার ৮৫০ কোটি টাকা কেন্দ্রীভূত এ খাতে।
এছাড়া ৮ শতাংশ ঋণ নিয়ে বস্ত্র খাত শীর্ষ চারে রয়েছে। গত বছর ৫৪ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পাঁচ হাজার ২৫০ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে এ খাতে। বস্ত্র খাতে মোট খেলাপি ঋণের ৮ দশমিক ৪ শতাংশ আটকে রয়েছে।
দেশের কয়েকটি ব্যাংকের কাছে কেন্দ্রীভূত আছে এসব খেলাপি ঋণ। মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৫২ শতাংশ দেশের পাঁচ ব্যাংকের কাছে রয়েছে । অন্যদিকে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মোট খেলাপি ঋণের ৬৫ শতাংশ ৯ শতাংশ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষায় খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। ঋণ বিতরণের সময় আইন-কানুনগুলো যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। ব্যাংক ঋণের বড় অংশ যাতে গুটিকয়েক নির্দিষ্ট খাত ও গ্রাহকের মধ্যে কেন্দ্রীভূত না হয় সেদিক নজর রাখতে হবে। এজন্য বড় ধরনের ঋণ না দিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণ বিতরণের তাগিদ দেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, সরকার ঘোষিত উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যাংক ও আর্থিকপ্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। করপোরেট খেলাপি সংস্কৃতি আর্থিক খাতকে যেন গ্রাস করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। সিস্টেমেটিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এমন আগ্রাসী বিনিয়োগ করা যাবে না।
প্রকাশিত রিপোর্টে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি সহনশীলতার পরীক্ষার ফলাফল দেখানো হয়েছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানের তুলনায় খেলাপি ঋণ বাড়লে দেশের ব্যাংকিং খাত আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী ১০ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না। খেলাপি ঋণ তিন শতাংশ বাড়লে মূলধন দাঁড়াবে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং ৯ শতাংশ বাড়লে তা মাত্র ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশে নেমে আসবে। শীর্ষ তিন গ্রহীতা ঋণ ফেরত না দিলে মূলধন সংরক্ষণ কমে দাঁড়াবে ৯ দশমিক ০৫ শতাংশ। এছাড়া সাত গ্রাহক ফেরত না দিলে তা আরও কমে দাঁড়াবে ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে ওই রিপোর্টে। গত বছর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৫৩ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ ঋণগ্রহীতা খাতগুলো হচ্ছে- বাণিজ্যিক, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়ি নির্মাণে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ মোট ঋণের ১৭ শতাংশ ঋণ দেয়া হয়েছে। এদিকে খেলাপি ঋণ ও সুশাসনের বিবেচনায় গত বছর সাত প্রতিষ্ঠান বিপজ্জনক তথা রেডজোনে, ২১ প্রতিষ্ঠান ইয়োলোজোনে এবং পাঁচ প্রতিষ্ঠান সুবিধাজনক গ্রিনজোনে রয়েছে। আগের বছর রেডজোনে ছিল ১০টি ও ইয়োলোজোনে ছিল ১৮টি এবং গ্রিনজোনে ছিল চার প্রতিষ্ঠান।
প্রতিবেদন প্রকাশকালে বাংলাদেশে ব্যাংকের চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট উপদেষ্টা আল্লাহ মালিক কাজেমি বলেন, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে আর্থিক খাতের ভূমিকা থাকবে অনেক বেশি। আর্থিক খাত দুই পায়ে হাঁটছে নাকি চার পায়ে হাঁটছে সেটি দেখতে হবে। কোন কোন খাত বেশি ঋণ পাচ্ছে, সেখানে আদায় কত, সেখানে খেলাপি ঋণ কত- এসব বিষয় বিবেচনায় রাখা দরকার। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আগ্রাসী বিনিয়োগ করা যাবে না।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান বলেন, খেলাপি ঋণ অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে। গুণগত ঋণ বিতরণ করে পর্যাপ্ত মূলধন নিশ্চিত করতে হবে এবং মুনাফা বাড়াতে হবে। ব্যাংকিং খাতকে গতিশীল ও ঝুঁকিমুক্ত করতে ক্যাশবিহীন বিকল্প লেনদেন বাড়ানো প্রয়োজন।
এসআই/এমএআর/আরআইপি