ভ্যাট নিয়ে পিছু হটছে সরকার
ভ্যাট আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন থেকে পিছু হটছে সরকার। নিবার্চনকে সামনে রেখে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মানে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলেও সেটা হবে নামমাত্র। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পাসের আগে ভ্যাট আইনে বড় ধরনের ছাড় থাকছে।
সোমবার জাতীয় সংসদে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বিষয়ে আলোচনার জন্য অর্থমন্ত্রী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের মন্ত্রী ও সচিবদের নিয়ে আলাদা একটি বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এসব নির্দেশনা দিয়েছেন বলে একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে প্রস্তাবিত বাজেটে আরোপিত ভ্যাট ও আবগারি শুল্কের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, নতুন ভ্যাট আইন ও আবগারি শুল্কের বিষয়ে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বাজেট পাসের আগে এগুলোর সমাধান করতে হবে। বাজেটের প্রভাবে যাতে জনমনে কোনো ধরনের অসন্তোষ না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে বাজেট পাসের আগেই এ বিষয়গুলো ঠিক করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
বৈঠকে তিনি বলেছেন, সরকার বাজেট দিয়েছে জনগণের উন্নয়নের জন্য। বাজেটের কারণে যদি জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হয় এমন বাজেট সংসদে পাস করা হবে না। বাজেটকে অবশ্যই জনবান্ধব করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর নতুন মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আইন আগামী অর্থবছর থেকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে সরকার আরও সময় নিচ্ছে। এই জন্য প্রস্তাবিত বাজেট পাসের আগে ভ্যাট আইনে বড় ধরনের ছাড় থাকছে। এর মধ্যে রয়েছে ভ্যাটের হার কমানো, ভ্যাটমুক্ত পণ্য ও সেবার তালিকা বাড়ানো, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবাখাতকে ভ্যাটের আওতামুক্ত করা, খাতভিত্তিক ভ্যাটের হার কমানো। নতুন আইনে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় যেসব সেবার উপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে সেগুলোর উপরও এই হার কমানো হচ্ছে।
সূত্র জানায়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জনঅসন্তোষ, ব্যবসায়ীদের তীব্র প্রতিবাদ এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকার নতুন ভ্যাট আইনে বড় ধরনের ছাড় দিতে যাচ্ছে। কেননা, আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটই শেষ বাজেট যেটি এই সরকার পুরো মেয়াদে বাস্তবায়ন করতে পারবে। ফলে এই বাজেটের প্রভাব ২০১৮ সালের শেষের দিকে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে পড়তে পারে। আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের যে বাজেট এই সরকার দেবে সেটি বাস্তবায়নের জন্য সময় পাবে মাত্র ৩ থেকে ৪ মাস। এই সংসদের মেয়াদ শেষ হবে জানুয়ারি প্রথম দিকে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ পূর্তির তিন মাস আগে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ হিসাবে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
গত ১ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করেন। ওই বাজেটে বলা হয়, আগামী অর্থবছরের শুরু থেকে অর্থাৎ আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা হবে। এর আগে ২০১২ সালে জাতীয় সংসদে নতুন ভ্যাট আইন পাস করা হয়েছে। এই আইনে কিছু সেবা ও পণ্য ছাড়া প্রায় সব সেবা ও পণ্যের উপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের কথা বলা হয়। একই সঙ্গে সবস্তরে এই হারে ভ্যাট দেয়ার নিয়ম করা হয়।
এই আইন বাস্তবায়ন হলে পণ্য আমদানি, উৎপাদন, বিপণন ও বড় বড় দোকানে খুচরা পর্যায়েও ভ্যাট দিতে হবে। এতে ভ্যাটের হার বেশি পড়বে। যে কারণে ভ্যাট রিবেট দেয়ার নিয়ম করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা সঠিকভাবে হিসাব রাখলে ১৫ শতাংশের অতিরিক্ত ভ্যাটের অর্থ ফেরৎ দেয়া হবে। নতুন আইনে গ্যাস, বিদ্যুৎ, চিকিৎসাসেবাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সবধরনের পণ্য ও সেবার উপর ভ্যাট আরোপ করা হয়।
দেশের ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা এই ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন। তারা বলেছেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়িত হওয়ার মতো কাঠামো বর্তমানে নেই। এই আইন বাস্তবায়ন করা একেবারেই অসম্ভব। এটি বাস্তবায়ন হলে সব পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাবে। যার প্রভাবে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। বর্তমান চালসহ নিত্যপণ্যের দাম এমনিতেই ঊর্ধ্বমুখী। এই অবস্থায় ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে এগুলোর দাম আরও উস্কে যাবে।
এছাড়া ব্যবসায়ীরা ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নামার হুমকি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে যেভাবে হিসাব রাখতে হবে এই কাঠামো হাতেগোনা কিছু ব্যবসায়ীর রয়েছে, বাকি কারও নেই। ফলে তারা ভ্যাট রিবেট সুবিধা পাবেন না। এছাড়া পণ্যের দাম বেড়ে গেলে ক্রেতা কমে যাবে। তখন ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ভ্যাট আইনটি চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকেই বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের বিরোধিতা ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রস্তুতি না থাকায় ওই অর্থবছর থেকে আইনটি কার্যকর করা হয়নি। ওই সময়ে সিদ্ধান্ত ছিল আগামী অর্থবছর থেকে এই আইনটি কার্যকর করা হবে। এই সময়ের মধ্যে আইনটি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করা হবে। কিন্তু ওই সময়ে ব্যবসায়ীদের কিছু প্রশিক্ষণ দেয়া ছাড়া আর কিছুই করা হয়নি। নতুন আইন চালু করতে হলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে কমপক্ষে আড়াই লাখ ইসিআর মেশিন দেয়ার কথা। গতকাল পর্যন্ত চার হাজার মেশিন দেয়া হয়েছে। আগামী দুই বছরে আড়াই লাখ মেশিন দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে এনবিআর।
সূত্র জানায়, বৈঠকে এই বাস্তবতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন এক বছর পেছানো হলো। কিন্তু ব্যবসায়ীদের এই বিষয়ে প্রস্তত করা হলো কেন? কাঠামো ঠিক না করেই কেন এই আইন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর এসব প্রশ্নের জবাবে নীতিনির্ধারকরা যেসব বক্তব্য দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তা আমলে নেননি। তিনি বরং অবকাঠামো প্রস্তুত না করে এবং ভোক্তাদের এ বিষয়ে সচেতন না করে কেন এই ধরনের আইন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একই সঙ্গে এই ধরনের উদ্যোগে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
সূত্র জানায়, আগামী ২৯ জুলাই বাজেট পাস হওয়ার কথা ছিল। ঈদের ছুটির কারণে সেটি একদিন এগিয়ে আনা হয়েছে। আগামী ২৮ জুলাই বাজেট পাস হতে পারে। এর আগেই ভ্যাট ও আবগারি শুল্কের ব্যাপারে জনবান্ধব সিদ্ধান্ত দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা পেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গতকাল থেকেই কাজ শুরু করেছেন। তারা আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই ভ্যাট ও আবগারি শুল্কের কাঠামো চূড়ান্ত করবেন।
উল্লেখ্য, আগামী অর্থবছরের বাজেটে মোট রাজস্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ভ্যাট থেকে। যা মোট রাজস্ব আয়ের ৩৬.৮ শতাংশ। মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভ্যাট থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের তৈরি ছকে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হচ্ছে।
এমএ/বিএ