ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

এবারও জনগণের টাকায় মেটান হলো ব্যাংকের দুর্নীতির দায়!

প্রকাশিত: ০২:৪৭ পিএম, ১৫ জুন ২০১৭

সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে বাড়তি রাজস্ব আদায় করছে সরকার। আর এর একটি অংশ অর্থাৎ দুই হাজার কোটি টাকা অনৈতিকভাবে সরকারই দিয়ে দিল সরকারি-বেসরকারি সাত ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে।

দুই হাজার কোটি টাকার মধ্যে এক হাজার কোটি টাকাই পেল স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্নীতিগ্রস্ত বেসিক ব্যাংক। বাকি এক হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে দুটি সরকারি ব্যাংক, দুটি সরকারি বিশেষায়িত ব্যাংক, দুটি সরকারি অংশীদারিত্বের বেসরকারি ব্যাংক এবং একটি সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের বরাদ্দ থেকে এ অর্থ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি আদেশে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্বাক্ষর করেছেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জনগণের করের টাকায় সরকারি ব্যাংকের দুর্নীতির দায় মেটানো অনৈতিক। এ অনৈতিক কাজ সরকার বছরের পর বছর করে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে দুর্নীতি হচ্ছে। ফলে এসব ব্যাংকে বাড়ছে মূলধন ঘাটতি। এ ঘাটতি মেটাতে সরকার আর্থিক খাতের সংস্কারের উদ্যোগ না নিয়ে প্রতি বছরই মূলধন জোগান দিয়ে যাচ্ছে। সংস্কার ছাড়া যা কখনোই কার্যকর হবে না বলে মন্তব্য করেন বিশ্লেষকরা।

অর্থমন্ত্রী স্বাক্ষরিত আদেশে দেখা গেছে, সরকারি বেসিক ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি বাবদ দেয়া হয়েছে এক হাজার কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি বাবদ দেয়া হয়েছে ৩০০ কোটি ও রূপালি ব্যাংকে ১০০ কোটি টাকা। সরকারি বিশেষায়িত ব্যাংক রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে সুদের ভর্তুকি বাবদ দেয়া হয়েছে ১০০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে সুদের ভর্তুকি বাবদ দেয়া হয়েছে ১৬৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।

সরকারি অংশীদারিত্বের বেসরকারি ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকে পরিশোধিত মূলধনের সরকারি অংশ বাবদ দেয়া হয়েছে ২২ লাখ টাকা এবং আইএফআইসি ব্যাংকে রাইট শেয়ারের চাঁদা বাবদ দেয়া হয়েছে ১৮৫ কোটি টাকা। এছাড়া সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনকে তহবিল সহায়তা বাবদ দেয়া হয়েছে ১০০ কোটি টাকা।

ব্যাংক সূত্রগুলো বলছে, ঋণের নামে সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা আত্মসাতের কারণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয় মূলধনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। চলমান অনিয়ম-দুর্নীতির পাশাপাশি অগ্রণী ব্যাংকে মুন গ্রুপ কেলেঙ্কারি, রূপালী ব্যাংকে ‘গোল্ড আনোয়ার’সহ আরও কেলেঙ্কারি হয়েছে নতুন করে।

এর আগে, সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপ জালিয়াতি এবং বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বে পুরো ব্যাংকেই বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। ব্যাংকগুলোর সূত্রে জানা গেছে, অন্তত এক হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ হয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে।

সরকার এ ঘটনাগুলোর নায়কদের বিচার করতে পারেনি, উল্টো বাজেটে বরাদ্দ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে আসছে। বাজেট সংক্ষিপ্তসারের অনুন্নয়ন ব্যয়ের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ অংশে ব্যাংকগুলোর জন্য রাখা বরাদ্দ দেখিয়ে আসছে ‘মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ’ নামে।

একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারি ও ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের কারণে বড় ধরনের মূলধন ঘাটতিতে আছে সরকারি ব্যাংকগুলো। এসব ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে এখন বাজেট বরাদ্দ দিয়ে। প্রতি বছরের বাজেটে ব্যাংকগুলোকে টাকা দেয়ার জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গত ১ জুন ২০১৭-১৮ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব হয়েছে তাতেও ব্যাংকগুলোকে দেয়ার জন্য রাখা হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এ নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। সিপিডি বলেছে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৫-১৬ পর্যন্ত (২০১৬-১৭ অর্থবছর বাদে) আট বছরের ক্রমবর্ধমান রাজস্ব আয় থেকে সরকার গড়ে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ অর্থ দিয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগানে।

সিপিডি অঙ্ক করে দেখিয়েছে, আট বছরের মোট রাজস্ব আয় আট লাখ ৬৮ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা এবং মোট ক্রমবর্ধমান (এক বছর থেকে আরেক বছরে যত টাকা বেশি) রাজস্ব আয় এক লাখ আট হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। এ আট বছরের মধ্যে সাত বছরই পুনর্মূলধনের নামে ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়েছে ১১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা, যা ক্রমবর্ধমান রাজস্ব আয়ের ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ রাজস্ব আয়ের ভালো একটি অংশ চলে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর জন্য।

সিপিডি বলছে, সম্পদ ঘাটতির বাংলাদেশে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে যেভাবে টাকা দেয়া হচ্ছে, তা দিতে না হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা সামাজিক খাতে টাকাগুলো খরচ করা যেত। এতে দেশও অনেক বেশি উপকৃত হতো।

শুধু এবারই প্রথম নয়, এর আগেও বেসিক ব্যাংকের আর্থিক সংকট মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে তিন দফায় দুই হাজার ৩৯০ কোটি টাকা দেয়া হয়। প্রথমবার ২০১৪ সালে দুই দফায় ৭৯০ কোটি ও ৪০০ কোটি টাকা এবং গত বছর আরও এক হাজার ২০০ কোটি টাকা দেয় সরকার।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জালিয়াতির দায় মোটানোর সরকারি সিদ্ধান্ত মোটেও যৌক্তিক নয়। দুর্নীতির কারণে সরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতিসহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ ঘাটতি জনগণের করের টাকা দিয়ে পূরণ করা উচিত নয়। এটা অনৈতিক। মূলধন ঘাটতি পূরণে এসব ব্যাংককে খেলাপি ঋণ আদায়ের ওপর জোর দিতে হবে। তা না করে সরকার যেটা করতে যাচ্ছে তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে পরিচালক নিয়োগ দেয় সরকার। তাদের সহযোগিতায় এসব ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। সরকার যদি এসব ব্যাংকে দক্ষ, সৎ ও নিষ্ঠাবান পরিচালক নিয়োগ দেয় তাহলে এত সহজে জালিয়াতিগুলো হতে পারত না। আর ঘাটতি পূরণে এত টাকাও দিতে হতো না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারি দলের লোকদের চাপসহ নানা কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো গুণগত মান যাচাই না করেই ঋণ দিচ্ছে। পরে যা আর আদায় হচ্ছে না। এতে তাদের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ বেড়ে মূলধনে ঘাটতির সৃষ্টি হচ্ছে। এসব ব্যাংকের মালিক যেহেতু সরকার, তাই সরকার জনগণের অর্থ দিয়ে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী মূলধন জোগান দিয়ে থাকে। ফলে ব্যাংকগুলো নিজেদের সংশোধনের প্রয়োজন অনুভব করে না।

তার মতে, এসব ব্যাংকের উচিত দেখেশুনে ভালো উদ্যোক্তাকে ঋণ দেয়া নিশ্চিত করা এবং মুনাফা বাড়ানোর মাধ্যমে মূলধনের ঘাটতি মেটানোর সক্ষমতা গড়ে তোলা।

এমইউএইচ/এমএআর/আরআইপি

আরও পড়ুন