অবশেষে স্বর্ণ আমদানিতে নীতিমালা হচ্ছে
দেশে দৈনিক প্রায় ১০ কোটি টাকার স্বর্ণের বাজার রয়েছে। চাহিদা অনেক বেশি হলেও বৈধ পথে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশে এক রতি স্বর্ণ আমদানি হয় না। দোষ কি শুধু ব্যবসায়ীদের? না। ব্যবস্থাপনা এমনই যে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে স্বর্ণ আমদানি সম্ভব নয়। ফলে বিদেশ থেকে যাত্রীদের আনা সামান্য স্বর্ণ এবং চোরাই পথের স্বর্ণ দিয়েই চলছে দেশের জুয়েলারি ব্যবসা। তবে এবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের টনক নড়েছে। তারা জুয়েলারি শিল্প ব্যবসাবান্ধব করার লক্ষ্যে স্বর্ণ আমদানির জন্য সময়োচিত ও বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
দেশে স্বর্ণের চাহিদা ও আমদানি জটিলতার বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর জন্য একটি পরিস্থিতিপত্র তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান স্বাক্ষর করেছেন।
পরিস্থিতিপত্রে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তিনি এ বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে চান। বাস্তবে স্বর্ণ নানাভাবে এ দেশে আসে এবং ব্যাপকভাবে তা ভারতে পাচার হয়। এ ব্যবস্থা থেকে আমরা পরিত্রাণ পেতে চাই। আমি ভাবছিলাম যে, বাস্তবতা স্বীকার করে আমরা স্বর্ণ আমদানির বিষয়ে আইনি স্বীকৃতি দেব। এ জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন দরকার।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, দেশের অর্থনীতি অনেক এগিয়েছে। তাই অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বর্ণের চাহিদাও বাড়ছে। অথচ এ ধাতব দ্রব্যটি দেশে উৎপাদন হয় না। তাই স্বর্ণ আমদানিতে সরকারকে অতি দ্রুত একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। নীতিমালা হলে বৈধ পথে ব্যবসায়ীরা স্বর্ণ আনবেন। ফলে এ খাত থেকে দেশ মোটা অংকের রাজস্ব পাবে। একই সঙ্গে স্বর্ণ চোরাচালন কিছুটা হলেও কমবে।
এ বিষয়ে এনবিআরের প্রস্তাব হচ্ছে, বর্তমানে এলসির মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি গ্রহণের যে আবশ্যকতা রয়েছে সেটি তাদের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে শিথিল করা যায়। শুধু ভ্যাট নিবন্ধিত জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানই স্বর্ণবার আমদানি করতে পারবে মর্মে বিধান করা যায়। আগামী ১ জুলাই থেকে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ বাস্তবায়ন হলে স্বর্ণ আমাদানিতে মূল্য সংযোজন করা আরোপিত হবে বিধায় এর উপর প্রযোজ্য স্পেসিফিক ডিউটি প্রত্যাহার করা যায়।
এতদিন স্বর্ণ আমদানির কোনো নীতিমালা ছিল না তাহলে এর চাহিদা মিটতো কীভাবে- এ বিষয়ে খোঁজ নিলে এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ফেরার সময় একজন বিমানযাত্রী লাগেজে করে বৈধভাবে সর্বোচ্চ ২০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণালঙ্কার বিনা শুল্কে দেশে আনার সুবিধা পেতেন। এছাড়া সর্বোচ্চ ২০০ গ্রাম পর্যন্ত সোনার বার আনতে একজন যাত্রীকে ভরিপ্রতি (এক ভরিতে ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) ১৫০ টাকা হারে শুল্ক দিতে হতো। সে সময় ভারতগামী এক যাত্রী ২০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণ সঙ্গে করে নিতে পারতেন। সে জন্য বিমানবন্দরে তাকে শুল্ক পরিশোধ করতে হতো ভরিপ্রতি নয় হাজার টাকা। ওই সময় বাংলাদেশে ব্যাগেজ রুলের আওতায় শুল্ক কম থাকায় বিদেশ থেকে স্বর্ণ এনে বাংলাদেশ থেকে চোরাই পথে ভারতে পাচারের হার উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যায়। ওই পরিস্থিতিতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ওই নিয়ম পরিবর্তন করে বিনা শুল্কে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণালঙ্কার আনার সুযোগ রাখা হয়। এছাড়া ২০০ গ্রাম বারের ক্ষেত্রে শুল্ক আনতে ভরিপ্রতি তিন হাজার টাকা পরিশোধ করার বিধান রাখা হয়।
এছাড়া দেশের চাহিদা মেটাতে চোরাই পথে আসা স্বর্ণই ছিল অন্যতম ভরসা। এর বাইরে ১৯৪৭ সালের ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্টের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নিয়ে এলসি খুলে স্বর্ণ আমদানির একটি পথ খোলা আছে। এ ব্যবসার ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) নিবন্ধন নম্বর থাকলেই বৈধভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে মোট মূল্যের ৪ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে দেশে স্বর্ণ আমদানি করার বিধান রয়েছে। তবে এ প্রক্রিয়া মানা বেশ কঠিন। তাই গত পাঁচ বছরে ব্যাংকের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে এক তোলা স্বর্ণও আমদানি করেনি ব্যবসায়ীরা। তবে দেশের ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ দাবি করে আসছেন।
এদিকে শুল্ক গোয়েন্দাসহ অন্যান্য সংস্থার অভিযানে জব্দ স্বর্ণ নিয়মিতভাবে নিলাম এবং বাণিজ্যিকভাবে তা আমদানির প্রক্রিয়া সহজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ।
চিঠিতে বলা হয়, চোরাচালানের দায়ে জব্দ স্বর্ণ ও বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা এবং পরবর্তীতে বাজেয়াপ্ত স্বর্ণ নিলামে বিক্রি করার বিধান রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ ধরনের বাজেয়াপ্ত স্বর্ণে নিলাম অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে এসব স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে দীর্ঘদিন ধরে জমা পড়ে আছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের ভেতরের উৎস থেকে বৈধ স্বর্ণ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে তাদের ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
শুল্ক গোয়েন্দারা সম্প্রতি বনানীতে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের মামলার অন্যতম আসামি সাফাত আহমেদের বাবা দিলদার আহমেদের মালিকানাধীন আপন জুয়েলার্সে অভিযান চালিয়ে প্রায় পাঁচশ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছে। এরপর মূল্যবান এ ধাতু আমদানিতে প্রক্রিয়াগত জটিলতার কথা বলেন ব্যবসায়ীরা।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর বলছে, বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) নেতারা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বৈধ সোনা সরবরাহের ব্যবস্থার দাবি করছেন। এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা রাজস্ব বোর্ড ও শুল্ক গোয়েন্দাদের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে আলোচনা করেন।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর আরও বলছে, বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানি নিষিদ্ধ না। এর যেন অবাধ প্রবাহ থাকে সেজন্য আমদানি নীতি রয়েছে। সেটা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে যেকোনো সময় যেকোনো পরিমাণ স্বর্ণ আনা যাবে বা কেনা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি যেন সহজলভ্য হয় এবং আবেদন যেন দ্রুত নিষ্পত্তি হয় সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা হচ্ছে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, তারা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, গত পাঁচ বছরে ব্যাংকের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে এক তোলা স্বর্ণও আমদানি হয়নি। সোনা আমদানির অনুমতি চেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি মাত্র আবেদনপত্র জমা আছে। এটি আমদানিতে রাজস্ব যা আদায় হয়েছে তা ব্যাগেজে আনা স্বর্ণের মাধ্যমে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ভরিপ্রতি ১৫০ টাকা শুল্ক দিয়ে মোট ৩১৫ কেজি ব্যাগেজে আনা স্বর্ণ দেশে আসে। এতে সরকারের রাজস্ব আদায় হয় পাঁচ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ব্যাগেজে আনা স্বর্ণে শুল্ক বাড়িয়ে ভরিপ্রতি তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। ওই বছর এভাবে ৪১১ কেজি স্বর্ণ দেশে আসে এবং সরকারের রাজস্ব খাতে আয় হয় সাড়ে ১২ কোটি টাকা।
এমইউএইচ/এআরএস/এমএআর/জেআইএম