ভুয়া এনআইডিতে এম ব্যাংকিং, বিপাকে গ্রাহকরা
রাজধানী ঢাকায় ভ্যান চালান আফলাক হোসেন। খরচ বাদে মাসের পুরো রোজগারের টাকা বিকাশের মাধ্যমে পরিবারের কাছে পাঠান কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার এ বাসিন্দা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সঙ্গে না থাকায় সেদিন টাকা পাঠাতে না পেরে ফিরে আসেন। পরে এনআইডি নম্বর দিয়ে পরিবারের কাছে নয় হাজার টাকা পাঠান তিনি।
কিন্তু এনআইডি নম্বর দিয়ে বিপাকে পড়েন আফলাক হোসেন। তার দেয়া এনআইডি দিয়ে একাধিক বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর অভিযোগ ওঠায় পুলিশি নজরদারিতে পড়েন। পরে পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি টিমের তদন্তে সত্য বেরিয়ে আসায় হয়রানি থেকে নিস্তার পান আফলাক হোসেন।
তদন্তে উঠে আসে, মিথ্যা তথ্যে অন্যের এনআইডি নম্বর ব্যবহার অথবা ভুয়া এনআইডি ব্যবহারে একাধিক লেনদেনের কথা।
এ বিষয়ে ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে এর প্রায় সবই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জন্য সুবিধাজনক নয়। যিনি টাকা লেনদেন করবেন তার পরিচয় নিশ্চিত করে মোবাইল ব্যাংকিং অবাধ ও স্বাধীন করা উচিত। এনআইডি দিলেই যে জালিয়াতি হবে না বা জঙ্গিবাদে যুক্তরা লেনদেন করতে পারবে না- এ গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। ভুয়া এনআইডি কিংবা অন্যের এনআইডি ব্যবহারে লেনদেন হচ্ছে কিনা- তা যাচাই করার মত পথ বের করতে হবে।
বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং এম-ব্যাংকিং এবং এসএমএস ব্যাংকিং হিসেবে পরিচিত। এ ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সেবা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেয়া হয়। এ জন্য গ্রাহককে কোনো ব্যাংকে যেতে হয় না। নব্বই দশকের শেষে অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে ইউরোপের ব্যাংকগুলো প্রথম এ ধরনের সেবা চালু করে। বাংলাদেশে প্রথম ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক এ সেবা নিয়ে আসে। এরপর অন্তত ডজন খানেক ব্যাংকে এ সেবা চালু হয়। ছয়টি মোবাইল কোম্পানি টেলিটক, সিটিসেল, গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল এ ব্যাংকিং সেবায় সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রাম ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্রে মোবাইল ব্যাংকিং চালুর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এদিকে, ২০১৭ সাল নাগাদ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটির কোটা ছাড়িয়েছে। ঘরে বসেই তারা বিভিন্ন ধরনের বিল প্রদান (বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি বিল), কেনাকাটা, বেতন-ভাতাসহ নানা ধরনের সেবা গ্রহণ করছেন।
পুলিশ ও র্যাবের দেয়া তথ্য মতে, জঙ্গি কর্মকাণ্ডসহ এর সঙ্গে জড়িতরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থের লেনদেন করে থাকে। অত্যন্ত সহজ ও দ্রুত টাকা পাঠানোর সুবিধা থাকায় এ পদ্ধতি কাজে লাগাচ্ছে তারা। এছাড়া বাংলাদেশকে নিয়ে এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের (এপিজি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জঙ্গি ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন, অর্থপাচার, জালিয়াতি ও চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে লেনদেনের সন্দেহে এক হাজার ৪৩০ ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ (জব্দ) করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রাজধানীর কল্যাণপুরের মারিয়া জেনারেল স্টোরের সত্ত্বাধিকারী ও বিকাশ এজেন্ট আব্দুল খালেক জানান, বিকাশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কড়াকড়ি করায় পরিচয়পত্রের ফটোকপি রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে কখনও এ নিয়ে তদন্ত করতে দেখিনি।
আনারুল ইসলাম নামে এক সরকারি কর্মকর্তা জানান, আমার ন্যাশনাল আইডি কার্ড দিয়ে টাকা লেনদেন করে এলাম। এরপর সেটা দিয়ে যে অপব্যবহার হবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে?
এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশ-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদির জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে গ্রাহকদের এনআইডি নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ইতিবাচক দিক বিবেচনা করেই এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিষয়টি বেশ ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বেসিস সভাপতি ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বারও। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে অনলাইনে লেনদেনের ক্ষেত্রে এনআইডি নম্বরের সংযুক্তি বাধ্যতামূলক করা বেশ বাস্তব ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে এনআইডি’র অপব্যবহার বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। কেননা নজরদারি না বাড়ালে অসাধুরা বেশি উপকৃত হবে।’
বেসিস সভাপতি মোস্তাফা জব্বার আরও বলেন, ‘শুধু এনআইডি নম্বর লিখে রাখা কোনো সমাধান হতে পারে না। এতে ভুয়া এনআইডি দিয়ে কিংবা অন্যের এনআইডি দিয়ে লেনদেন হলে বৈধরাই হয়রানির শিকার হবে। মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের এনআইডি আসল না নকল তা পরীক্ষা করার অনুমতি দিতে হবে। এছাড়া নিবন্ধিত মোবাইল নম্বর সংযোজন করে তা দিয়েও এনআইডি পরীক্ষার অনুমতি রাখলে আসল-নকল ধরা পড়বে।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে অর্থায়ন বন্ধ প্রসঙ্গে সিআইডির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, জঙ্গিদের জন্য অনলাইন ব্যাংকিং খুবই সহজ মাধ্যম। অর্থায়ন বন্ধ করা গেলে জঙ্গিরা আর দাঁড়াতে পারবে না। নজরদারি বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, অনলাইন লেনদেন চালুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিশেষ নজরদারিতে এটি রাখা। লেনদেনকারীর পরিচয় নিশ্চিত করা। ভুয়া এনআইডিধারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হলে আর কেউ নতুন করে এ ধরনের কাজ করতে সাহস পাবে না।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে এনআইডি নম্বর নথিভুক্ত রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে পাঁচ হাজার টাকার কম লেনদেনের ক্ষেত্রে এনআইডি নম্বর প্রযোজ্য নয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা জাগো নিউজকে বলেন, হুন্ডি ও অপব্যবহার রোধে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে পাঁচ হাজার টাকা বা এর বেশি নগদ অর্থ জমা বা উত্তোলনে গ্রাহককে পরিচয়পত্র বা স্মার্টকার্ডের ফটোকপি প্রদর্শন করতে হবে, যা এজেন্ট তার রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করবেন। রেজিস্ট্রারে গ্রাহকের স্বাক্ষর বা টিপসই সংরক্ষণের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
যদি কেউ লেনদেনে ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করেন এবং এজেন্ট তা যাচাই-বাছাই না করেন সেক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ আসলে এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ ধরনেরও একটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানান শুভঙ্কর সাহা।
জেইউ/এমএমএ/আরএস/এআরএস/আরআইপি