ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

বিনিয়োগ ভেঙে খাচ্ছে পদ্মা লাইফ

প্রকাশিত: ০৬:৪২ এএম, ১০ এপ্রিল ২০১৭

নানা অনিয়মে ডুবতে বসেছে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায় ধস নামার পাশাপাশি কমে গেছে লাইফ ফান্ডের আকার। ইনভেস্টমেন্ট রিটার্ন বা বিনিয়োগ থেকে আয়ও কমে গেছে। খরচ মেটাতে আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে অবৈধভাবে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করা হচ্ছে। এমনকি বিনিয়োগও ভাঙতে হয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জীবন বীমা কোম্পানিটির।

প্রতিষ্ঠানটি ২০১২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর একে একে তিনটি বছর চলে গেলেও বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশই দিতে পারেনি। ফলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার এক বছর পরই পচা কোম্পানির (জেড গ্রুপ) তালিকায় স্থান হয় পদ্মা ইসলামী লাইফের।

নানা অনিয়ম ও আইন লঙ্ঘন করায় ২০১৩ সাল থেকে পদ্মা ইসলামী লাইফের ভ্যালুয়েশনের বেসিস অনুমোদন আটকে দেয় বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। বেসিস অনুমোদন না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের অ্যাকচুয়ারি ভ্যালুয়েশন (আর্থিক মূল্যমান) করতে পারেনি। আর ভ্যালুয়েশন না হওয়ায় লভ্যাংশ ঘোষণা করাও সম্ভাব হয়নি।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির আবেদনের সময়ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানটি। এ নিয়ে গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপরও কোম্পানিটিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার অনুমোদন দেয় বিএসইসি।

বিএসইসির একটি সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে পদ্মা লাইফের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করতে গিয়ে পরিচালকদের মাধ্যমে ভুয়া বিল-ভাউচার দিয়ে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ খুঁজে পায় বিলুপ্ত অধিদফতের নিয়োজিত অডিট ফার্ম। একই সঙ্গে কোম্পানিটি ২০০৯ সালের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনের হিসাবে গোঁজামিল করে। এসব তথ্য গোপন করে আইপিও’র অনুমোদন পেতে আবেদনে করা হয়। এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ আসে বিএসইসিতে।

ওই অভিযোগ থেকে জানা যায়, পদ্মা লাইফ ২০০৪ সাল পর্যন্ত অ্যাকচুয়াল ভ্যালুয়েশন রিপোর্টে আট কোটি টাকার বেশি লোকসানের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করলেও পরিচালকরা তাদের মূলধন তিন কোটি টাকার উপর ১৫ শতাংশ হারে লভ্যাংশ বাবদ এক কোটি ৩৫ লাখ টাকা তুলে নেন। তিনটি খাতে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে কোম্পানির একাধিক প্রকল্প থেকে ওই টাকা পরিচালকরা তুলে নেন।

এমন অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোম্পানির চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের দুই কোটি টাকা জরিমানা করে তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশ তোয়াক্কা না করে নানা কৌশলে তা ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। এমনকি বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন থাকার পরও কোম্পানির আইপিওর জন্য প্রকাশিত প্রসপেক্টাসে সে তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি।

এদিকে পদ্মা লাইফের সর্বশেষ অর্থাৎ ২০১৬ সালের ব্যবসা সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বছরটিতে প্রথম বর্ষ ও নবায়ন উভয় প্রিমিয়াম আয় কমে গেছে। ভাঙা হয়েছে বিনিয়োগ। কমেছে লাইফ ফান্ডের আকার। ইনভেস্টমেন্ট রিটার্ন বা বিনিয়োগ থেকে আয়ও কমে গেছে। আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে অবৈধভাবে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করা হয়েছে। তামাদি হয়েছে আগের বছর বিক্রি করা প্রায় সিংহভাগ পলিসি।

আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা লাইফ ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় খাতে আইন লঙ্ঘন করে ১৬১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ করেছে। এর মধ্যে ২০১০ সালে ২৪ কোটি ৬৯ লাখ, ২০১১ সালে ৩৭ কোটি ৩১ লাখ, ২০১২ সালে ৩২ কোটি ৯১ লাখ, ২০১৩ সালে ৩১ কোটি ৫৪ লাখ, ২০১৪ সালে ২৫ কোটি ১১ লাখ, ২০১৫ সালে ছয় কোটি সাত লাখ এবং ২০১৬ সালে তিন কোটি ৯৩ লাখ টাকা আইন লঙ্ঘন করে ব্যয় করা হয়।

প্রতি বছর আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি পদ্মা লাইফের বিক্রি করা পলিসির সিংহভাগ পরের বছরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালে যে পলিসি বিক্রি করেছিল ২০১৬ সালে এর মাত্র ৩১ দশমিক ৪৬ শতাংশ নবায়নে আদায় হয়েছে। অর্থাৎ বাকি ৬৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ পলিসি বছর না ঘুরতেই বন্ধ হয়ে গেছে।

এর আগে, আগের বছর বিক্রি করা পলিসি ২০১৫ সালে ১৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৪২ দশমিক ৪৩ শতাংশ, ২০১৩ সালে ২৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, ২০১২ সালে ৮৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০১১ সালে ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং ২০১০ সালে ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ নবায়নে আদায় হয়।

পাশাপাশি যে পলিসিগুলো দ্বিতীয় বছরে নবায়নে আদায় হয়েছে এরও বড় অংশ পরবর্তীতে তামাদি (বন্ধ) হয়ে যাচ্ছে। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে মোট ২১ হাজার ৪৪২টি পলিসি তামাদি হয়েছে। ২০১৫ সালে ৫৪ হাজার ৪০০টি, ২০১৪ সালে ৩৫ হাজার ৭৩১টি, ২০১৩ সালে ৫০ হাজার ৭৬টি, ২০১২ সালে ২২ হাজার ৮৬৪টি, ২০১১ সালে ৯৭ হাজার ৪৮৮টি এবং ২০১০ সালে এক লাখ ৬৫ হাজার ৯৩৬টি পলিসি তামাদি হয়।

প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে পদ্মা ইসলামী লাইফের বিনিয়োগ ছিল ২৭১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২৬৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। পরের বছর ২০১৫ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ২৫৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আর সর্বশেষ ২০১৬ সাল শেষে বিনিয়োগ কমে দাঁড়িয়েছে ২২১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০১৩ সালের পর থেকে প্রতি বছরই প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ ভাঙা হয়েছে।

বিনিয়োগ ভাঙার কারণে প্রতিষ্ঠানটির ইনভেস্টমেন্ট রিটার্ন বা বিনিয়োগ থেকে আয় কমে গেছে। ২০১৬ সালে বিনিয়োগ থেকে আয় হয়েছে ১১ কোটি ২৯ লাখ টাকা, যা ২০১৫ সালে ছিল ১৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর আগের বছর ২০১৪ সালে বিনিয়োগ থেকে আয় হয় ২২ কোটি ৯ লাখ এবং ২০১৩ সালে ২৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০১৩ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভবে বিনিয়োগ থেকে আয় কমেছে।

আইডিআরএ সূত্রে আরও জানা গেছে, আইন লঙ্ঘন করে গ্রাহকের টাকা খরচ করায় প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখতে ২০১৫ সালে নিরীক্ষক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান পদ্মা লাইফের ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিন বছরের আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখে আয়-ব্যয়, গাড়ি, জমি ও বিল্ডিং, নগদ টাকা, ট্যাক্স ও ভ্যাট, চেয়ারম্যান এবং পরিচালকদের সম্মানীসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য পায়।

নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে পদ্মা লাইফের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য উঠে আসলেও গত দেড় বছরে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি আইডিআরএ। উল্টো দীর্ঘদিন খালি থাকা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে গত মার্চে হঠাৎ করে চৌধুরী মো. ওয়াসিউদ্দীনের নিয়োগ অনুমোদন করা হয়। অথচ আইন অনুযায়ী ওয়াসিউদ্দীন বীমা কোম্পানির সিইও হওয়ার যোগ্য নন। অযোগ্য ব্যক্তিকে সিইও নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা পদ্মা লাইফের ভ্যালুয়েশনের বেসিসও অনুমোদন দেয় আইডিআরএ।

যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএ চেয়ারম্যান পদে থাকা এম শেফাক আহমেদ সম্প্রতি জাগো নিউজকে বলেন, বেসিস অনুমোদন না দিলে কোনো কোম্পানি লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে না। তাই বেসিস অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

তবে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিন বছরের বেসিস অনুমোদন আটকে রাখার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। আর নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসা বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে শেফাক আহমেদ বলেন, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে যে সব তথ্য উঠে এসেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সার্বিক বিষয়ে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে পদ্মা ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যান এফ এম ওয়বাইদুর রহমান এবং মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়া চৌধুরী মো. ওয়াসিউদ্দীনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এমএএস/এমএআর/জেআইএম

আরও পড়ুন