চরম অব্যবস্থাপনা জীবন বীমা কর্পোরেশনে
চরম অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের মধ্যদিয়ে চলছে সরকারি মালিকানাধীন দেশের একমাত্র লাইফ ইন্স্যুরেন্স জীবন বীমা কর্পোরেশন। প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর ধরে আইন লঙ্ঘন করে গ্রাহকদের টাকা মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করছে।
এছাড়া অস্তিত্বহীন এজেন্টের নামে খরচ করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে প্রিমিয়াম আয়। এমনকি গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা অর্ধেক পলিসি বছর ঘুরতেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গ্রাহকের বীমা দাবির টাকা পরিশোধেও টালবাহানা করছে কোম্পানিটি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেষ গত ৮ বছরে জীবন বীমা কর্পোরেশন ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের খাতে সীমা লঙ্ঘন করে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে খরচ করেছে। এরমধ্যে শেষ বছরে অর্থাৎ ২০১৬ সালে অবৈধভাবে ব্যয় করা হয়েছে ৬৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। তার আগের বছর ২০১৫ সালে অবৈধভাবে ব্যয় করা হয় হয় ৫১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে এ অবৈধ ব্যযের পরিমাণ ছিল ৪৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
এছাড়া ২০১৩ সালে ৪৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা, ২০১২ সালে ৩৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, ২০১১ সালে ৪৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, ২০১০ সালে ২৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা এবং ২০০৯ সালে ১৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা অবৈধভাবে খরচ করা হয়। অর্থাৎ প্রতিবছরই প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনা খাতে মোটা অঙ্কের টাকা অবৈধভাবে খরচ করছে। শেষ দুই বছরে (২০১৫ ও ২০১৬ সাল) এ ব্যয়ের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।
ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের খাতে কোম্পানিটি অবৈধভাবে যে অর্থ ব্যয় করেছে তার ৯০ শতাংশ বীমা গ্রাহক (পলিসিহোল্ডার) এবং বাকি ১০ শতাংশ শেয়ার গ্রাহকদের (শেয়ারহোল্ডার) প্রাপ্য। অর্থাৎ ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের খাতে অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে কোম্পানির পলিসি হোল্ডার ও শেয়ার হোল্ডারদের প্রায় সাড়ে তিন’শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
গ্রাহককে ফাঁকি দিতে অবৈধ ব্যয়ের পাশাপাশি প্রতিবছর মোটা অঙ্কের পলিসি তামাদি করে দিচ্ছে সরকারি এই জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির ১৮ হাজার ৫০৬টি পলিসি তামাদি করা হয়েছে। আগের বছর ২০১৪ সালে তামাদি হয় ২৪ হাজার ১৬২টি পলিসি। এছাড়া ২০১৩ সালে ২২ হাজার ২৫৭টি, ২০১২ সালে ২৪ হাজার ৭৯৫টি, ২০১১ সালে ২২ হাজার ১৫৪টি, ২০১০ সালে ৩৫ হাজার ২৪টি ও ২০০৯ সালে ১৯ হাজার ৪৯৬টি পলিসি তামাদি হয়েছে।
এদিকে ২০১৫ সালে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করা পলিসির অর্ধেক প্রিমিয়াম ২০১৬ সালে নবায়ন বাবদ আদায় করতে পারেনি জীবন বীমা কর্পোরেশন। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি নতুন পলিসি বিক্রি করে প্রিমিয়াম আয় করে ৯৪ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে নবায়নে যার ৫১ দশমিক ৬৪ শতাংশ বা ৪৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা আদায় হয়েছে। অর্থাৎ বছর না ঘুরতেই কোম্পানিটির ৪৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকার পলিসি বন্ধ হয়ে গেছে।
পলিসি তামাদি হওয়ার কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটির নবায়ন প্রিমিয়াম আয় কমেছে ২৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আগের বছর ২০১৫ সালে নবায়ন প্রিমিয়াম আয় কমেছিল ২০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ২০০৯ সাল থেকেই কোম্পানিটির নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ে এ দুরবস্থা বিরাজ করছে। বছরে নবায়ন প্রিমিয়ামের ৫০ শতাংশ আদায় করাই এখন প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়েছে।
২০০৯ সালে জীবন বীমা কর্পোরেশনের নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ের পরিমাণ ছিল ৪৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। পরের বছর ২০১০ সালে তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। এরপর ২০১১ সালে ৩৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, ২০১২ সালে ৪৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৪৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৫২ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে ৪৭ দশমিক ১২ শতাংশ নবায়ন প্রিমিয়াম আদায় করতে সক্ষম হয় প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে অবৈধভাবে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করায় দুর্বল হয়ে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা। ফলে বীমা পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও বড় অঙ্কের গ্রাহকের দাবির টাকা অপরিশোধিত থেকে যাচ্ছে। গত নভেম্বর শেষে ৯ হাজার ৭৬৮ জন গ্রাহকের বীমার দাবির টাকা অপরিশোধিল। আর ডিসেম্বর শেষে দাবির টাকা না পাওয়া গ্রাহকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৬৯৪ জনে। গ্রাহকের দাবির টাকা পরিশোধ না করায় এবং মোটা অঙ্কের পলিসি তামাদি হয়ে যাওয়ায় গ্রাহকের আস্থা হারিয়েছে কোম্পানিটি।
এদিকে আইডিআরএ’র এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জীবন বীমা কর্পোরেশন থেকে জানানো হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে ৫০ হাজারের ওপর এজেন্ট কর্মরত আছে। তবে এদের বেশিরভাগই নামমাত্র এজেন্ট। মূলত যারা কাজ করছেন তারা অন্যদের নাম ব্যবহার করে কমিশন গ্রহণ করছেন। তবে আইডিআরএর তথ্য অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিতে ৬ হাজার ৭১৪ জন এজেন্ট কাজ করছে এবং তাদের তত্ত্বাবধানের জন্য কোনো এমপ্লয়ার অব এজেন্ট নেই।
এসব অনিয়মের বিষয়ে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে জীবন বীমা কর্পোরেশনের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফরহাদ হোসেন ব্যস্ততা দেখিয়ে কথা বলতে অস্বীকৃত জানান।
এমএএস/এমএমজেড/পিআর