চার হাত বদলে ২ টাকার ফুলকপি হচ্ছে ১৫ টাকা
নওগাঁ সদর উপজেলার কুমুরিয়া গ্রামের কৃষক আজিজুল হক চলতি মৌসুমে ১০ কাঠা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছিলেন। বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) সকাল ৬টার দিকে নওগাঁ-রাজশাহী আঞ্চলিক মহাসড়ক সংলগ্ন ডাক্তারের মোড়ে ২০০ পিস ফুলকপি ভ্যানযোগে বিক্রি করতে আসেন তিনি। প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর এসব ফুলকপি মাত্র ৪০০ টাকায় বিক্রি করতে হয় তাকে।
এ মৌসুমে ফুলকপির উৎপাদন খরচ ও দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তিনি। বলেন, লাভের আশায় ৯ হাজার টাকা খরচ করে ফুলকপি চাষ করেছিলাম। জমিতে অবশিষ্ট ২০০ পিছ ফুলকপি বিক্রির মধ্য দিয়ে এবারের সর্বমোট বিক্রিত মূল্য দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ হাজার টাকা। বিনিয়োগের ৫ হাজার টাকা ও শ্রম পুরোটাই লোকসান।
এদিন ডাক্তারের মোড়ে ভোর থেকেই সদর উপজেলার দূর দূরান্ত থেকে ভ্যানযোগে উৎপাদিত ফুলকপি বিক্রির উদ্দেশ্যে আনছিলেন কৃষকরা। তবে ক্রেতার সংখ্যা ছিল খুবই কম। যার প্রভাবে যেসব ব্যবসায়ীরা এখানে সরাসরি কৃষকদের থেকে ফুলকপি কিনছিলেন, তাদের কাউকেই প্রতি পিছ ফুলকপির দাম ২-৪ টাকার বেশি হাঁকতে দেখা যাচ্ছিল না। তাই কম দামে ফুলকপি বিক্রির এ ক্ষোভ শুধুমাত্র কৃষক আজিজুলের ছিল না।
এদিকে ডাক্তারের মোড় থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত নওগাঁ শহরের বৃহত্তর পাইকারি কাঁচাবাজার। তাই ডাক্তারের মোড় থেকে যেসমস্ত ব্যবসায়ী ফুলকপি কিনছিলেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ফুলকপিগুলো পুনরায় বিক্রির উদ্দেশ্যে ভ্যানযোগে পাইকারি কাঁচাবাজারের পথে রওনা হচ্ছিলেন।
এমনই একজন ব্যবসায়ী সামিউল ইসলাম মিঠু। ২ টাকা দরে ৪০০ পিস ফুলকপি কেনার পর এসব ফুলকপি পাইকারি কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে ৪-৫ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা যায় তাকে।
ওইসময়ে কথা হলে ব্যবসায়ী সামিউল ইসলাম মিঠু জাগো নিউজকে বলেন, ভেবেছিলাম পাইকারিতে প্রতি পিস ফুলকপি অন্তত ৭ টাকা দরে বিক্রি করতে পারবো। কিন্তু আসার পর দেখছি এখানেও সিন্ডিকেট। ৩-৪ টাকার বেশি দামে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কেউই ফুলকপি কিনতে চাচ্ছে না। অথচ আরেক হাত বদলেই খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে তারাই আবার ১০ টাকা পিস দরে ফুলকপি বিক্রি করছেন।
মিঠুর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পাইকারি ব্যবসায়ী মুকুল হোসেন বলেন, ৪-৫ টাকা পিস দরে ভালো মানের ফুলকপি পাওয়া যায় না। যেসমস্ত ফড়িয়া ব্যবসায়ী আমাদের কাছে ফুলকপি আনছেন সেসব ৬-৭ টাকা পিস দরে কিনতে হচ্ছে। এ দামে কেনার পর খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে ১০ টাকা দরে বিক্রি করছি। এখানে দোষের কিছু নেই।
অপরদিকে পাইকারি বাজার থেকে মানভেদে প্রতি পিস ফুলকপি ৯-১০ টাকা দরে কেনার পর খুচরা ব্যবসায়ীরা এসবের পসরা সাজিয়ে পার্শ্ববর্তী গোস্তহাটির মোড় খুচরা কাঁচাবাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুত রাখছেন। ৩ হাত বদলের পর চতুর্থ ধাপে এবার সেই ফুলকপি ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিছ ১৫ টাকা দরে।
হাত বদলে ২ টাকার ফুলকপি ১৫ টাকায় বিক্রির কারণ জানতে চাইলে শহরের গোস্তহাটির মোড় কাঁচাবাজারের মোহাম্মদ আলী স্টোরের খুচরা ব্যবসায়ী আব্দুল আলিম বলেন, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে কৃষকরা বরাবরের মতোই উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ সিন্ডিকেট ভাঙতে কৃষিপণ্য বিপণনে মধ্যস্থতা কমিয়ে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করতে হবে। সেইসঙ্গে সরাসরি কৃষককে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যায়ে লেনদেনের সুযোগ দিতে হবে। তাহলেই কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবেন।
নওগাঁ সদর উপজেলার বর্ষাইল ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের কৃষক ময়নুল হক বলেন, ৪ বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করতে গিয়ে ৮০ হাজার টাকা খরচ করেছি। ভেবেছিলাম এবার অন্তত দেড় লাখ টাকার ফুলকপি বিক্রি করতে পারবো। অথচ এখন খরচের অর্ধেক টাকা ওঠানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। ২ বিঘা জমির ফুলকপি বিক্রি করে মাত্র ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। এখন যেভাবে পানির দরে ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে এ মৌসুমে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা লোকসান হবে।
তিনি বলেন, বাজার সিন্ডিকেটে যেভাবে ফুলকপির দরপতন হলো, এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে ফুলকপির আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে চাষিরা। হাটের কোথাও বাজার মনিটরিংয়ে প্রশাসনের নজরদারি নেই। তাই অসহায় হয়ে কম দামে ফুলকপি বিক্রি করতে হচ্ছে। অনেক চাষি এবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বে। এ সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রশাসনের নিয়মিত বাজার মনিটরিং প্রয়োজন।
তবে কৃষকদের এসব অভিযোগের সঙ্গে একেবারেই দ্বিমত পোষণ করেছেন নওগাঁ জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সোহাগ সরকার। তিনি বলেন, বাজারে কোনো সিন্ডিকেট নেই। মাসের প্রায় ২৮ দিনই বাজার মনিটরিং করা হয়। এরপরও সিন্ডিকেট তৈরি হলে সেটা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব শুধুমাত্র কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে নয়। টাস্কফোর্স কমিটিসহ ভোক্তা অধিকার চাইলেই ব্যবস্থা নিতে পারেন। আগাম জাতের শীতকালীন শাকসবজির আবাদ তুলনামূলক হারে বেড়ে যাওয়ায় এ দরপতন।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, এ বছর জেলায় ৫৭৫ হেক্টর জমিতে ফুলকপি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও ৬২০ হেক্টর জমিতে ফুলকপি আবাদ করেছেন চাষিরা। যেখানে ১৭ হাজার ৩৬০ মেট্রিক টন ফুলকপি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার সারাদেশেই ফুলকপির বাম্পার ফলন হয়েছে। তাই বাহিরের জেলার ক্রেতারা নওগাঁ থেকে ফুলকপি কিনতে আসছেন না। মূলত এই কারণেই নায্যদাম থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে চাষিদের।
আরমান হোসেন রুমন/এফএ/এএসএম