ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেজবার অবাক করা গল্প!

এম মাঈন উদ্দিন | প্রকাশিত: ০১:০৭ পিএম, ০৯ জানুয়ারি ২০২৫

জন্ম থেকে পৃথিবীর আলো দেখেননি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেজবা উদ্দিন। তবুও প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে সাবলীলভাবে করে যাচ্ছেন ইলেকট্রিক কাজ, মাইকিং ও দেশের সকল অপারেটরের সিমের মোবাইল রিচার্জ। যে কাজে একজন সুস্থ মানুষকেও বেগ পেতে হয়, সেই কাজ নিখুঁতভাবে করে জীবিকা নির্বাহ করেন এই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী যুবক। মিরসরাই পৌরসদর ও গ্রামের সবার কাছে সমান জনপ্রিয় তিনি।

মেজবা উদ্দিন (৩৬) মিরসরাই পৌর সদরের মধ্যম মঘাদিয়া গ্রামের জামাল উল্ল্যাহর নয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট। জন্মগতভাবে তিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী। তাকে নিয়ে যেন গ্রামবাসীর কৌতূহলের শেষ নেই, ঠিক তেমনি আছে বুকভরা ভালোবাসা।

পারিবারিক জীবনে মেজবা ও তার স্ত্রী তানজিনার রয়েছে ২ পুত্র সন্তান। বড় ছেলে মোনতাজুল মাহাদির বয়স ৭ বছর হলেও পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে এখনো স্কুলে ভর্তি করাতে পারেননি। ছোট ছেলে আব্দুল আউয়াল মহিবের বয়স ৩ বছর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জন্মগত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেজবা উদ্দিন ১০ বছর বয়সে হেফজখানায় ভর্তি হন। সেখান থেকে ১২ পারা কোরান মুখস্থ করলেও পুরো শেষ করতে পারেননি। ১৩ বছর বয়সে তিনি ইলেকট্রিক কাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করেন। কাজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে কেনেন একটি মোবাইল ফোন। সেই মোবাইল ফোন নিয়ে শুরু করেন বিভিন্ন সিম অপারেটরের রিচার্জ ব্যবসা। এর পাশাপাশি মাইকিং করে উপার্জিত অর্থ নিয়ে চলে তার স্ত্রী সন্তানসহ ৪ সদস্যের পরিবার। তবে মোবাইল রিচার্জের ব্যবসায় মন্দা যাওয়ায় কিছুটা হতাশ এই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী যুবক। বিত্তবানদের সহযোগিতা পেলে একটি দোকান দিয়ে অভাব ঘোচাতে চান বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মানুষ মারা গেলে প্রচারের ডাক পড়ে মেজবার। কোনো অনুষ্ঠান কিংবা নির্বাচনী প্রচারণায় মাইকিং করতে মেজবার বেশ কদর রয়েছে। মাইকে কী বলতে হবে একবার বলে দিলেই হয়। একবার কারো সঙ্গে কথা হলেই তার কণ্ঠ গেঁথে থাকে তার স্মৃতিতে। ফোন নম্বর নিজের সেটে সংরক্ষণ করা, তালিকা থেকে প্রয়োজনীয় নম্বরটি খুঁজে বের করা, প্রয়োজনীয় অপশনে গিয়ে কাজ করা সবই করতে পারেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেজবা।

গ্রামের ছেলেদের নিয়ে পিকনিক, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেন মেজবা। গ্রামে নারকেল, সুপারি কিংবা তাল পাড়তে গাছে উঠতেও মেজবার ডাক পড়ে সবার আগে। পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরাও তার কাছে কোনো বিষয় নয়। এসবের বাইরেও তার আয়ত্তে আছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক ঘটনা। কেউ খবরের কাগজ পড়লে কিংবা আড্ডায় আলোচনা করলে কান পেতে দেন।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেজবার অবাক করা গল্প!

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেজবা উদ্দিন বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই কিছু করার চেষ্টা করেছি। জানতাম পরিবার বেশিদিন আমার বোঝা বইতে পারবে না। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বলে অনেকে নিরুৎসাহিত করলেও আমার লক্ষ্যের প্রতি আমি স্থির ছিলাম। ইলেকট্রিক কাজ করে টাকা জমিয়ে মোবাইল কিনেছি। সেই মোবাইলে সাবলীলভাবে নম্বর তুলতে পারায় আমি মোবাইল রিচার্জের ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হই। এরপর মিরসরাই পৌর বাজারে মোবাইল রিচার্জের ব্যবসার শুরু করি। দোকান না থাকায় আমি বাজারে হেঁটে হেঁটে মোবাইল রিচার্জ বিক্রি করি।

এখান থেকে আমি প্রতি হাজারে ২৮ টাকা কমিশন পাই। মাসে আমার ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার বেশি মোবাইল রিচার্জ হয়। প্রথমে কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা আমাকে সিম দিতে অস্বীকৃতি জানালেও পরে বাজারে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় আমি সিম নিতে পারি। মোবাইল রিচার্জ করতে করতে স্থানীয় একটি মাইকের দোকানদারের সঙ্গে পরিচিত হই। সেখান থেকে মাইকিংয়ের কাজও শুরু করি। মৃত ব্যক্তির মাইকিংয়ের কাজে আমার কোনো চাহিদা থাকে না। মানুষ কিছু দিলেও খুশি না দিলেও খুশি। কারণ একদিন সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।

ইলেকট্রিক কাজে ঝুঁকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে ঝুঁকি মনে হয় না। এই কাজ করতে আমার ভালো লাগে। অনেক সময় কাজের পর অনেক মানুষ আমার ন্যায্য মজুরি দিতে চায় না, এজন্য দুঃখ লাগে।’

স্থানীয় গ্রামবাসী গিয়াস উদ্দিন বলেন, মেজবার স্মৃতিশক্তি দেখে আমরা মাঝে মাঝে অবাক না হয়ে পারি না। সে মোবাইলের কললিস্ট থেকে নম্বর খুঁজে আমাদের ফোন দেয়। গ্রামের দোকানে বসে মোবাইল সেটে গান শুনে। আশ্চর্যের বিষয়, মেমোরিতে থাকা লিস্ট থেকে সেরা গানগুলো বাছাই করে শোনে সে।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেজবা প্রসঙ্গে কথা হয় চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতালের ট্রাস্টি চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. রবিউল হোসেনের সঙ্গে।

তিনি বলেন, কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়া সাধারণত এমন কাজ করা উচিত নয়। তবে ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব। চিকিৎসাবিজ্ঞান বৈদ্যুতিক কাজের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সাধারণত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের উৎসাহ দেয় না। আমার মতেও তাদের এমন কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ।

এফএ/এএসএম