ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

কক্সবাজারে অপ্রতিরোধ্য মানবপাচার, টার্গেট ‘রোহিঙ্গারা’

সায়ীদ আলমগীর | কক্সবাজার | প্রকাশিত: ০৬:১৩ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪

শুষ্ক মৌসুমে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে উপকূলকেন্দ্রিক মানবপাচার চক্র। প্রশাসনিক শত চাপেও থামানো যাচ্ছে না তাদের অপতৎপরতা। উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বল্প খরচে বিনা ভিসায় মালয়েশিয়া বা অন্য দেশে যাওয়ার প্রলোভনে সমুদ্র উপকূলে জড়ো করা হচ্ছে। চক্রের ফাঁদে পড়ে ট্রলারে ওঠা মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুকদের সাগরে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরিয়ে সমুদ্রের টেকনাফ-কক্সবাজারের কোনো উপকূলে নামিয়ে পালাচ্ছেন পাচারকারীরা।

কোনো ট্রলার বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে মিয়ানমার বা থাইল্যান্ড পৌঁছাতে পারলে সেখানকার পাচার চক্রের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশ উপকূল থেকে তুলে নেওয়া রোহিঙ্গা কিংবা বাংলাদেশিদের। সেখানে আটকে তাদের মাধ্যমে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপণের লাখ লাখ টাকা। এভাবে নিঃস্ব হচ্ছে হতদরিদ্র পরিবারগুলো।

গত দুই মাসে পাচারের শিকার অন্তত দুইশ জনকে উদ্ধার করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টেকনাফ-উখিয়ায় কর্মরত সদস্যরা। সবশেষ শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) রাতে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ লম্বরীর এক বসতবাড়ি থেকে মালয়েশিয়া যেতে জড়ো করা ৩০ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে পুলিশ। এদের মধ্যে ১৫ জন পুুরুষ, তিনজন নারী, সাতজন ছেলে শিশু আর পাঁচজন মেয়ে শিশু ছিল। তাদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে যেতে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পাচারচক্রের সদস্যরা পালিয়ে যান বলে জানান টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন।

তার আগে ১৭ নভেম্বর ভোরের দিকে টেকনাফের বাহারছড়া কচ্চপিয়া পাহাড়ি এলাকা থেকে মালয়েশিয়ায় পাচারের জন্য আটকে রাখা রোহিঙ্গাসহ ৩১ জনকে উদ্ধার করে র্যাব। এরমধ্যে ২৭ জন রোহিঙ্গা ও চারজন বাঙালি। এ ঘটনায় টেকনাফের হ্নীলার পানখালী ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত অছিউর রহমানের ছেলে মো. আনোয়ার (৪৪) ও সদর ইউনিয়ন উত্তর লম্বরী ২ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত রফিকের ছেলে আতিকুর রহমানকে (৩২) আটক করা হয়।

৪ নভেম্বর ভোরে টেকনাফের সদর ইউনিয়নের লম্বরী এলাকার পর্যটন বাজার থেকে মালয়েশিয়া পাচারকালে ১২ রোহিঙ্গা উদ্ধার ও চার দালালকে আটক করা হয়। সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে লোকজড়ো করা হয়েছে এমন খবরে অভিযান চালিয়ে পুলিশ এ চার দালালকে আটক ও ১২ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে।

এর আগে ১৪ অক্টোবর সকালে উখিয়ার ইনানী সৈকত থেকে ২৬ রোহিঙ্গাকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। টেকনাফ উপকূল থেকে ট্রলারে তুলে গভীর সমুদ্রে ১০ দিন ঘুরিয়ে ‘মালয়েশিয়া বলে’ ট্রলারে থাকা শতাধিক রোহিঙ্গাকে ইনানী সৈকত উপকূলে নামিয়ে পালিয়ে যায় দালালচক্র। এদের মধ্যে বেশিরভাগই তীরে উঠে সরে গেলেও ২৬ জন আটক হন। পরে তাদের কুতুপালং ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হয় বলে জানান উখিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ আরিফ হোসেন।

ওইসময় একজন রোহিঙ্গা জানিয়েছিলেন, টেকনাফ থেকে রাতের আঁধারে ট্রলারে যাত্রা করে মিয়ানমারের জলসীমা অতিক্রমকালে সে দেশের নৌবাহিনী বাধা দেয়। পরে মাঝি ট্রলার ঘুরিয়ে নেয় এবং সাগরে ১০ দিন এদিক সেদিক চালিয়ে ১৪ অক্টোবর ভোরে ‘মালয়েশিয়া তীরে এসেছি’ বলে সবাইকে ইনানী নামিয়ে দেন।

সূত্রগুলো বলছে, শুধু বাংলাদেশ থেকে লোকজন জড়ো করছে এমন নয়, মিয়ানমারে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদেরও দালালচক্র টাকার বিনিময়ে এদেশে অনুপ্রবেশ করাচ্ছে। গত ৯ অক্টোবর টেকনাফে সাগরপথে এসে মেরিন ড্রাইভ পেরিয়ে অনুপ্রবেশকালে নারী-শিশুসহ ৩৭ রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয় বলে জানান ওসি গিয়াস উদ্দিন।

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মংডু শহরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে তারা তীরে জড়ো হয়ে ট্রলারে বাংলাদেশে চলে আসেন। এখান থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা বলেন দালালরা। বাংলাদেশে আনতে দালালরা তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা নেন বলে জানান উদ্ধার রোহিঙ্গাদের কয়েকজন। এভাবে বঙ্গোপসাগর তীরের বাংলাদেশ অংশের উখিয়া-টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী, ঈদগাঁওয়ের ইসলামপুর, পোকখালী দিয়ে সুযোগ বুঝে পাচার করা হচ্ছে মানুষ।

মানবপাচার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা উইনরক ইন্টারন্যাশনালের ফোকাল পারসন এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, বিশ্বে লাভবান অবৈধ ব্যবসায় প্রথম অস্ত্র, দ্বিতীয় মাদক আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে মানবপাচার। স্মাগলিং দেশের বিরুদ্ধে অপরাধ আর ট্রাফিকিং ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ। পাচার ঘটনা প্রমাণ কষ্টসাধ্য। ফলে অভিযোগগুলো প্রমাণ না হওয়ায় পাচারচক্র শাস্তির বাইরে থাকছে।

তিনি বলেন, আগে বাঁচার তাগিদে পাচারের শিকার হলেও এখন ট্র্যাপের মাধ্যমে পাচার হন শিক্ষিত মানুষও। ৪০ জন আইটি ইঞ্জিনিয়ারকে কম্বোডিয়া নিয়ে স্ক্যামিংয়ের কাজ করানো হয়েছিল। পরে তারা উদ্ধার হয়ে ফিরে এসেছেন। এদের সবাই উচ্চ শিক্ষিত।

কক্সবাজারে অপ্রতিরোধ্য মানবপাচার, টার্গেট ‘রোহিঙ্গারা’

উখিয়া-টেকনাফ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রাসেল বলেন, উখিয়া, টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সদরের কিছু অংশ ‘মানবপাচারের উর্বর ভূমি’ বলা যায়। কক্সবাজারে মৌসুমভিত্তিক অপরাধী রয়েছে। বৃষ্টিতে অপহরণ কম হয়। এসময় পাহাড়ে অবস্থান কষ্টসাধ্য আর শুষ্ক মৌসুমে যেখানে-সেখানে অবস্থান করা যায় বলে অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময়টাতে সাগরও তুলনামূলক শান্ত থাকে বলে নৌপথে পাচার বাড়ে।

তিনি বলেন, অপরাধীদের সাজা দিয়ে ভালো করা যাবে না। বিবেকবোধ বাড়ানো গেলেই কেবল অপরাধী মনের মৃত্যু ঘটানো সম্ভব।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ফাহমিদা বেগম বলেন, নিয়মিত মুসল্লির পাশাপাশি সপ্তাহে জুমার দিন সমাজের সববয়সী মানুষ মসজিদে যান। সেখানে মানবপাচারের কুফল বিষয়ে বয়ান করতে ইমামদের প্রশাসনিক নির্দেশনা দেওয়া যায়। সমাজের প্রতিটি সেক্টর থেকে মানবপাচার বিরোধী কাজ করা দরকার।

উইনরক ইন্টারন্যাশনালের কক্সবাজার অফিসের মানবপাচার রোধ প্রকল্পের সমন্বয়ক মুহাম্মদ শাহ আলম বলেন, মানবপাচার প্রতিরোধে তৃণমূলে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ চলছে। স্কুল, উঠান বৈঠক এবং মানবপাচার প্রতিরোধ কমিটির সভা নিয়মিত হয়। পাচার হয়ে ফেরত আসা তরুণদের নিয়ে গঠন করা ‘অনির্বাণ’ নামে এক সংগঠন কক্সবাজারে পাচারবিরোধী কার্যক্রম চালাচ্ছে।

আর্থিক দৈন্যতা ও লোভ আমাদের পাচারের ঝুঁকিতে ফেলছে বলে মনে করেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা।

তিনি বলেন, জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশের মানুষ পাচারের শিকার হয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করলে পাচার রোধ অনেকাংশে সম্ভব।

কক্সবাজার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের চেষ্টার কমতি যেমন নেই, তেমনি পাচারকারীদের অপচেষ্টাও থামছে না। অকূল পাথারে থাকা রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে মাঠে বিচরণ করছে পাচারচক্র। এটা রোধ করতে সচেতনতা দরকার। আমরা ক্যাম্পে পাচারবিরোধী তথ্য প্রচারের ব্যবস্থা করছি।

এসআর/এমএস