৫০০ টাকা এসি মেরামতের বিলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তোলেন ২২ হাজার!
দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় ভেঙে পড়েছে পাবনার বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবা কার্যক্রম। হাসপাতাল ঘিরে প্রকাশ্যে সক্রিয় একাধিক দালাল চক্র। স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধেও অবহেলা ও দুর্ব্যবহারের পাহাড়সম অভিযোগ। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফাতেমাতুজ জান্নাতের বিরুদ্ধে।
হাসপাতাল ও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া নথি বলছে, ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে (এসি) পাখি ঢুকে পড়ায় সমস্যা দেখা দেয়। পার্শ্ববর্তী কাশীনাথপুর বাজারে আলিম রেফ্রিজারেটর ও ইলেকট্রনিক্সের মেকানিক আলিমকে ডেকে তা সারালে বিল হয় মাত্র ৫০০ টাকা। কিন্তু ওই তারিখে আলিমের দোকানের ভাউচারে দুটি এসি ও পাঁচটি ফ্রিজ মেরামত খরচ দেখিয়ে ২০২৩ সালের ৬ জুন ২২ হাজার টাকা উত্তোলন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যেখানে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফাতেমাতুজ জান্নাতের সই রয়েছে।
এ ঘটনার এক মাস আগে ২০২২ সালের ৭ আগস্ট ওই পাঁচটি ফ্রিজ পাশের ফরিদপুর উপজেলার বনওয়ারীনগরের জে কে রেফ্রিজারেটর থেকে মেরামতের ভাউচার দেখিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে ২০ হাজার টাকা। একই বছরের মে মাসে একই দোকানের ভাউচারে দুটি এসির মেরামত দেখিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে ১৮ হাজার টাকা। অথচ এই অস্বাভাবিক মেরামত খরচের বিষয়ে কিছুই জানে না মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
কাশীনাথপুর বাজারের আলিম রেফ্রিজারেটর ও ইলেকট্রনিক্সের স্বত্বাধিকারী আলিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওই সময়ে আমি একটি এসি সার্ভিসিং করেছিলাম। এসির তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। একটি পাখি ভেতরে ঢুকে মারা যাওয়ায় এসি কাজ করছিল না। আমি খুলে সেটি পরিষ্কার করে দিলে ভালো হয়ে যায়। সেদিন আমাকে ৫০০ টাকা বিল দেওয়া হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, যে ভাউচারে ২২ হাজার টাকার বিল তোলা হয়েছে, তাতে দেওয়া আমার দোকানের নাম, আমার নাম ও মোবাইল নম্বর সবই ঠিক আছে। কিন্তু ভাউচারটি আমার নয়। এটি জাল ভাউচার। এসময় তার মূল ভাউচার দেখান মেকানিক আলিম।
একইভাবে বিল ও ভাউচারের বিষয়ে জানতে ফরিদপুর উপজেলার বনওয়ারীনগরের জে কে রেফ্রিজারেটর সার্ভিস সেন্টারের স্বত্বাধিকারী শরিফুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আমি বা আমার প্রতিষ্ঠানের কেউ কখনো কাজ করেননি। কোনো বিলও আমি করিনি।
তাহলে আপনার ভাউচারে বিল কীভাবে হলো, জানতে চাইলে শফিকুল আলম বলেন, ‘যারা পরিচিত রয়েছেন, তারা অনেকেই বিভিন্ন সময় দু-একটি ভাউচার চান। সম্পর্কের খাতিরে অনেককেই দিতে হয়। হয়তো সেভাবে নিয়েছিল।’
শুধু এসি বা ফ্রিজ মেরামতে নয়, করোনাকালে স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া সম্মানী ভাতাও নয়-ছয়ের অভিযোগ উঠেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। বিধিবহির্ভূত প্রক্রিয়ায় ওই সময়ে হাসপাতালের নাইটগার্ড, আনসার সদস্য, স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের স্বেচ্ছাসেবী দেখিয়ে জুলাই ২০২১ থেকে জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত তুলে নেওয়া হয়েছে প্রায় ৯ লাখ টাকা। সেখানে সবগুলো স্বেচ্ছাসেবীর বিল তোলা হয়েছে একজনের ভুয়া সইয়ে। এমন অনিয়মেও সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ হাসপাতালটির শীর্ষ কর্মকর্তা ফাতেমা তুজ জান্নাতের বিরুদ্ধে।
এ ব্যাপারে হাসপাতালে দায়িত্বরত আনসার সদস্য জুয়েল রানা বলেন, ‘করোনার সময় আমরা বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছি। লাইন ঠিক করা, সিরিয়ালি লোক ঢোকানোসহ বিভিন্ন কাজ করেছি। পরে বিলও পেয়েছি।’
তবে সরকারি দায়িত্বে থেকে স্বেচ্ছাসেবী হতে পারেন কি না জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি এই আনসার সদস্য।
হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই স্থানীয়দের। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও তার নাগাল পান না সেবাপ্রার্থীরা। হাসপাতাল কম্পাউন্ডেই দেখা গেলো বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স। এক্স-রে, ইসিজি ও সাধারণ প্যাথলজি পরীক্ষার আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও রোগীদের পাঠানো হয় আশপাশের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সরকারের বিনামূল্যের ওষুধ, সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজও কিনতে হয় বাড়তি দামে। প্রতিবাদ করলেই দুর্ব্যবহার, হয়রানির অভিযোগ স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফাতেমা তুজ জান্নাত বলেন, জনবল সংকটে প্রত্যাশিত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর দুর্নীতির অভিযোগ সত্য নয়।
ভুয়া বিল ভাউচারে টাকা উত্তোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, কাজগুলো (মেরামত) করানো হয়েছে। কিন্তু এখন তারা (মেরামতকারী) কেন অস্বীকার করছেন জানি না। করোনায় লোকবল না পেয়ে যাদের দিয়ে কাজ করানো হয়েছে, তারা সবাই বিল পেয়েছেন। কোনো অনিয়ম হয়নি।
পাবনার সিভিল সার্জন ডা. শহীদুল্লাহ দেওয়ান বলেন, যেসব বিল ভাউচারের কথা বলা হচ্ছে তা আমার যোগদানের আগের। হাসপাতালের কর্মীদের স্বেচ্ছাসেবী ভাতা নেওয়ার সুযোগ নেই। অভিযোগ পেলে সত্যতা যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আলমগীর হোসাইন নাবিল/এসআর/জেআইএম