দফায় দফায় বাড়ছে চালের দাম, থামাবে কে?
কিছুতেই চালের দামের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। দফায় দফায় বাড়ছে দাম। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে সবধরনের চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে। আর খুচরা বাজারে মিনিকেটসহ সবধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে চার টাকা। কুষ্টিয়ার বাজারে চালের দাম বাড়লে সারাদেশেও দাম বেড়ে যায়।
দফায় দফায় চালের দাম বাড়ায় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। ক্ষুব্ধ ক্রেতারা বলছেন, যেভাবে সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে, তাতে চালের দাম সেঞ্চুরি ছুঁতে আর খুব বেশি দিন হয়তো অপেক্ষা করতে হবে না।
সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) কুষ্টিয়ার সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে পরিচিত পৌর বাজার এবং বড় বাজারে খোঁজ নিয়ে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে সবধরনের চালের দাম কেজিতে চার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ শ্রেণির সবচেয়ে বেশি পছন্দের মিনিকেট (সরু) চাল ৭০ টাকা থেকে চার টাকা বেড়ে ৭৪ টাকা, বাসমতি চাল ৮৮ টাকার স্থলে ৯২ টাকা, কাজললতা ৬৬টাকা থেকে বেড়ে ৭০ টাকা, আঠাশ (মোটা) চাল ৫৪ টাকার পরিবর্তে ৫৮ টাকা এবং স্বর্ণা চাল ৫০ টাকা কেজির বদলে ৫৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং মিনিকেট চালের সবচেয়ে বড় মোকাম হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত কুষ্টিয়ার খাজানগর মিলগেটেও সবধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে। এই মোকামে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই দফায় চালের দাম বাড়িয়েছেন মিল মালিকরা।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রধান জানান, ডিসেম্বরের প্রথম দিক থেকেই কুষ্টিয়ায় চালের দাম বাড়া শুরু হয়েছে। মিনিকেট চাল ১৫ দিন আগে ৫০ কেজির বস্তা ছিল ৩৪০০ টাকা। এখন দাম প্রতিকেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে। অন্যান্য চালের মধ্যে বাসমতি চাল কেজিতে তিন টাকা বেড়েছে। আঠাশ চাল কেজিতে দুই টাকা এবং স্বর্ণাসহ অন্যান্য চালের দামও ১৫ দিনের ব্যবধানে দুই টাকা বেড়েছে। বাজারে মোটা স্বর্ণা এবং আঠাশ মণপ্রতি ১৫০ টাকা বেড়েছে। মিনিকেট ধান প্রতিমণে ২০০ টাকা করে বেড়েছে। এখন মিনিকেটের সিজন না। মৌসুম আসতে আরও তিন মাস সময় লাগবে।
জয়নাল আবেদীন দাবি করেন, মিনিকেট এবং বাসমতি চালের দাম বাড়লে এর প্রভাব অন্য চালের ওপর গিয়ে পড়ে। এ সমস্যার সমাধানে দ্রুত সরু চাল আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণে নেওয়া এবং চালের বাজারের পাশাপাশি মিল-মালিকদের ধান-চাল মজুত নিয়মিত কঠোরভাবে মনিটরিং করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
মিনিকেট চালের জন্য কুষ্টিয়ার খাজানগর সারা দেশে পরিচিত। এখানে ৬৪টি অটো চালকলে এই চাল উৎপাদিত হয়। প্রতিদিন শত শত ট্রাক মিনিকেট চাল ঢাকাসহ সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। মিলমালিকেরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে প্রতিকেজি মিনিকেট চালের দাম ছিল ৬৭ টাকা। ১০ অক্টোবর সেই দাম কমে দাঁড়ায় সাড়ে ৬৬ টাকায়। এরপর থেকে এই চালের চাহিদা বাড়তে থাকে।
খাজানগরের গোল্ডেন রাইস মিলের মালিক জিহাদুজ্জামান জিকু বলেন, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে মিনিকেট চাল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত ধানের দাম মণপ্রতি ৩০০ টাকা বেড়েছে। এক সপ্তাহ আগে যে ধানের দাম ছিল মণ ১ হাজার ৫০০ টাকা, তা এখন ১ হাজার ৮০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে মিলগেটে মিনিকেট চালের দাম বাড়াতে হয়েছে।
কুষ্টিয়া পৌর বাজারের চাল ব্যবসায়ী হাজি আসাদুজ্জামান বলেন, পুরোনো ধানের ক্রাইসিস চলছে। পুরোনো ধান বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। মিনিকেট ধান ১৮০০ থেকে ১৮২০ টাকা, বাসমতি ধান ২১০০ টাকা মণ দরে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে ধানের দাম বেশি হলে মিলগেটেও চালের দাম বেড়ে যায়। আর মিলগেটে বেশি দামে চাল কিনতে হলে খুচরা বাজারে অটোমেটিক চালের দাম বেড়ে যায়।
কুষ্টিয়া পৌর বাজারে চাল কিনতে আসা স্কুলশিক্ষক রবিউল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কুষ্টিয়ায় চালের দাম যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তাতে কেজি ১০০ টাকায় গিয়ে ঠেকতে আর খুব বেশিদিন সময় লাগবে না। তিনি চালের দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট এবং সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করেন।
খাজানগরের কয়েকজন চাল ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মূলত খাজানগরের ১০-১২ জন ব্যবসায়ী দীর্ঘ প্রায় ১৫-১৬ বছর ধরে মিনিকেট চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সাবেক এমপি মাহবুব উল আলম হানিফের অতি ঘনিষ্ট এসব ব্যবসায়ীরা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সিন্ডিকেট করে দফায় দফায় চালের দাম বাড়িয়েছেন।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর এসব ব্যবসায়ীরা অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সিন্ডিকেট করে চালের দাম ইচ্ছেমতো বাড়াচ্ছে কিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।
কুষ্টিয়ার জ্যেষ্ঠ কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সুজাত হোসেন খান বলেন, এবার ধানের ফলন আগের চেয়ে কম হয়েছে। তাই দেশে ধানের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। তারপরও চালের দাম যেভাবে বাড়ছে, তা গুটিকয়েক মিলমালিকের কারণে। তারা করপোরেট চাল কোম্পানির সঙ্গে মিল রেখে চালের দাম দফায় দফায় বাড়িয়ে দিচ্ছেন। দাম বাড়ার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক তৌফিকুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোথাও কোনো অসংগতি আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হবে। এ বিষয়ে কোনো গড়মিল পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আল-মামুন সাগর/এসআর/এমএস