লাপাত্তা দালালরা
লিবিয়ায় ২৪ যুবকের খোঁজ নেই, মুক্তিপণে নিঃস্ব পরিবার
শরীয়তপুর সদর উপজেলার চর চটাং এলাকার ইকবাল হোসেন কাজী ও সাথী বেগম দম্পতির একমাত্র সন্তান শামীম কাজী (১৯)। ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে ৯ মাস আগে স্থানীয় দালালের মাধ্যমে দেশ ছাড়েন। লিবিয়ায় যাওয়ার পর আটক হন মাফিয়া চক্রের হাতে। গত ২২ মার্চ থেকে নিখোঁজ তিনি।
এরইমধ্যে দালাল চক্র হাতিয়ে নিয়েছে ১৩ লাখ টাকা। এরপরও খোঁজ মেলেনি তার। সন্তানের খোঁজ পেতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বাবা-মা। নাতির শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন দাদি শাহেরজান। সারাক্ষণ বিলাপ করে খুঁজে ফেরেন নাতিকে।
কান্না করতে করতে তমালের দাদি শাহেরজান বলেন, ‘একটা মাত্র নাতি আমার। তিনপোলার ঘরে ও একাই। ওর ছবি দেখলে এহন আমার কইলজাডা ফাইড্ডা যায়। ১২ বছর ওরে কোলে রাখছি যাতে কষ্ট না পায়। যাওয়ার সময় কথা দিছিলো আবার আমার সাথে দেহা হইবো। কই আমার নাতি? ওরে তো আর দেহিনা আমি। সরকার যেন আমার নাতিরে ফিরাইয়া দেয়, এইডাই দাবি।’
ছেলেকে ফিরে পেতে আশায় বুক বেঁধে আছেন মা সাথী আক্তারও। তিনি বলেন, ‘১৩ লাখ টাকা দিছি দালালরে। এখন আমি টাকা চাই না, আমার ছেলের জান চাই। দালাল আমার ছেলের কোনো খোঁজ দেয় না। আমি আমার ছেলেরে বুকে ফেরত চাই।’
শামীম কাজীর মতো নিখোঁজ রয়েছেন শরীয়তপুরের ১৫ যুবক। নিখোঁজের তালিকায় যোগ হয়েছে পার্শ্ববর্তী জেলা মাদারীপুরের আরও ৯ জনের নাম। গত ২২ মার্চ থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে নিখোঁজ ২৪ যুবকের। কয়েক দফায় মুক্তিপণ নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার খোঁজ মিলছে না তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদেশ যেতে ইচ্ছুক এমন তরুণ ও যুবকদের টার্গেট করে দালাল চক্র। তাদের কৌশলে নানা প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করা হয়। একপর্যায়ে ১৫-২০ লাখ টাকায় চুক্তিতে ইতালির কথা বললেও নিয়ে যাওয়া হয় উত্তর আফ্রিকার ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণের দেশ লিবিয়ায়। এরপর সেখানে মাফিয়ার হাতে তুলে দিয়ে জিম্মি করে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কাছ থেকে আদায় করা হয় আরও ৫-৮ লাখ টাকা।
স্থানীয় ও জনপ্রতিনিধি সূত্র জানায়, দালালের মাধ্যমে ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পর ৯ মাস ধরে নিখোঁজ শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের ২৪ জন তরুণ। তারা একই দালালের মাধ্যমে দেশ ছাড়েন।
নিখোঁজ ওই ২৪ তরুণ হলেন শরীয়তপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ মধ্যপাড়া এলাকার চুন্নু ভূঁইয়ার ছেলে আল আমিন, মালেক ফকিরের ছেলে আম-আমিন ফকির, দক্ষিণ ভাষানচর এলাকার সালাম আকনের ছেলে দিদার আকন, ইদ্রিস আলী খার ছেলে আমিনুল ইসলাম, সুফিয়ার সরদারের ছেলে ফারুক সরদার, চর নেয়ামতপুর এলাকার সলিম জমাদ্দারের ছেলে রাশিদুল, বোরহান মৃধার ছেলে সিরাজ, আব্দুল মান্নান খার ছেলে আতিকুর রহমান, চর চটাং এলাকার ইকবাল কাজীর ছেলে শামীম কাজী, জাহাঙ্গীর মোড়লের ছেলে রফিক মোড়ল, আব্দুল মান্নান ওঝার ছেলে মিরাজ ওঝা, চর যাদবপুর এলাকার সিরাজ মোল্লার ছেলে সাঈদ মোল্লা, মানিক ফরাজীর ছেলে শহিদুল ইসলাম, দরিচর এলাকার হাতেম শেখের ছেলে জাফর শেখ, কদমতলী এলাকার সালমান শিকদারের ছেলে শাহিন শিকদার, মাদারীপুর সদর উপজেলার নতুন মাদারীপুর এলাকার খালেক মোল্লার ছেলে রিমন মোল্লা, হাবিব হাওলাদারের ছেলে সিয়াম হাওলাদার, আব্দুল বেপারীর ছেলে নাহিদ বেপারী, হাবীব বেপারীর ছেলে নাঈম হোসেন, চাপাতলী এলাকার শাহ আলম সরদারের ছেলে সরদার সাকেবুল, জাফরাবাদ এলাকার ইউনুস সিকদারের ছেলে দিপু শিকদার, ত্রিভাগদি এলাকার রহিম হাওলাদারের ছেলে শাহাজান হাওলাদার, কালকিনি উপজেলার জাগির এলাকার শাহাজাহান খানের ছেলে মোহাম্মদ পারভেজ ও সূর্যমণি এলাকার ফারুক পেদার ছেলে সাইফুল ইসলাম।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলো জানায়, ইতালিতে নিয়ে চাকরির প্রলোভন দেখান শরীয়তপুর সদর উপজেলার আংগারিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ ভাষানচর এলাকার মৃত নুরুল ইসলাম খার যমজ ছেলে এলাকার চিহ্নিত দালাল কামরুজ্জামান ওরফে টুনু খা এবং রাশেদ খা। ওই ২৪ তরুণ চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি তাদের মাধ্যমে দেশ ছেড়েছিলেন। এরপর ইতালির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়ে লিবিয়ায় গিয়ে নিখোঁজ হন তারা।
তাদের খোঁজ পেতে ও দেশে ফেরানোর দাবি জানিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে আর্জি জানিয়ে আবেদন, মানববন্ধন কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন দপ্তরে ধরনা দিচ্ছেন ভুক্তভোগীর স্বজনরা। এছাড়া দালালের বিচার নিশ্চিত করতে মামলা করেছে ভুক্তভোগী কয়েকটি পরিবার। এতে উল্টো মামলার হুমকি দিচ্ছে দালাল চক্রটি।
মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর সহায় সম্বল বিক্রি আর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ১৫ লাখ টাকা তোলেন মাহফুজা বেগম। পরে ওই টাকা দিয়ে ছেলে হিমেলকে ইতালিতে পাঠান। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে যোগাযোগ না হওয়ায় ছেলের চিন্তায় তিনি এখন পাগলপ্রায়।
ছেলেকে ফেরত পাওয়ার আকুতি জানিয়ে মাহফুজা বেগম বলেন, ‘দালাল টুন্নু আর রাশেদ খা আমার এলাকার। ওদের প্রলোভনে আমার ছেলে সৌদি থেকে চলে এসেছিল ইতালি যাবে বলে। পরে সহায়-সম্বল বিক্রি করে আর ব্যাংক থেকে ঋণ উঠিয়ে দুই দফায় ১৫ লাখ টাকা দিয়েছি। এখন আমার ছেলে কোথায় আছে, কেমন আছে জানি না। টাকা-পয়সা পেয়ে দালালরা এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। আমি আমার ছেলেকে ফেরত চাই।’
ভুক্তভোগী ও নিখোঁজ আমিনুলের বাবা ইদ্রিস আলী খান বলেন, ‘ছেলের চিন্তায় আমরাও শেষ হয়ে যাচ্ছি। অন্তত নিখোঁজ ছেলের খোঁজ চাই। সরকারের কাছে একটাই দাবি, আমাদের সন্তানদের দেশে ফিরিয়ে আনা হোক। দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।’
এদিকে মুক্তিপণের টাকা আদায়ের পর এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন দালাল চক্রের সদস্য রাশেদ ও টুন্নু। তাদের ব্যবহৃত ফোন নম্বরটিও বন্ধ রয়েছে। তাদের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। দুটি ঘরই ছিল তালাবদ্ধ। এ বিষয়ে মুখ খুলছে না প্রতিবেশীরাও।
তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিতে মানবপাচারকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিয়েছেন পুলিশ সুপার সুপার নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি অবগত আছি। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। জেলার সঙ্ঘবদ্ধ মানবপাচারকারীদের তালিকা তৈরি করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
বিধান মজুমদার অনি/এসআর/এমএস