১১ বছরেও খোঁজ মেলেনি কুমিল্লা বিএনপির ২ শীর্ষ নেতার
দীর্ঘ ১১ বছরেও খোঁজ মেলেনি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা ও সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু এবং হুমায়ুন কবির পারভেজের। ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এদের ফিরে পেতে এখনো প্রহর গুনছেন স্বজন ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা।
বিশেষ করে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর কথিত ‘আয়নাঘর’ থেকে গুম হওয়া একাধিক ব্যক্তি ফিরে আসার খবরে তৎপর হয়ে ওঠেন ওই দুই বিএনপি নেতার পরিবারের সদস্যরা। যদিও হিরু-হুমায়ুন বেঁচে থাকার বিষয়ে কোনো আশ্বাস পাননি তারা।
স্থানীয় সূত্রমতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে ২০১৩ সালে বিএনপির টানা অবরোধ কর্মসূচি চলছিল। একই বছরের ২৭ নভেম্বর রাত ৯টার দিকে কুমিল্লার লাকসামে বিশেষ অভিযান চালায় র্যাব-পুলিশসহ যৌথ বাহিনী। একপর্যায়ে লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম হিরুর মালিকানাধীন ‘লাকসাম ফ্লাওয়ার মিলে’ অভিযান চালিয়ে ৯ জনকে আটক করা হয়।
খবর পেয়ে রাতেই সাইফুল ইসলাম হিরু, লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে লাকসাম থেকে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
একপর্যায়ে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের লালমাই উপজেলার হরিশ্চর-আলীশ্বর এলাকায় পৌঁছালে সাদা পোশাকে একদল লোক অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে র্যাব পরিচয়ে তিনজনকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে কুমিল্লার দিকে চলে যায়। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে জসিম উদ্দিন ও লাকসামে আটক হওয়া ৯ জনকে লাকসাম থানায় হস্তান্তর করে র্যাব। পরদিন ২৮ নভেম্বর সকালে তাদের বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কুমিল্লা কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এরপর থেকে বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবিরের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
অপহরণ ও গুমের অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৮ মে র্যাবের ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কুমিল্লার আদালতে মামলা করেন হুমায়ুন কবিরের বাবা রঙ্গু মিয়া।
মামলায় আসামিরা হলেন বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক (সিইও) ও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, র্যাব-১১এর তৎকালীন কুমিল্লা ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা কোম্পানি অধিনায়ক-২ মেজর শাহেদ হাসান (রাজীব), উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) শাহজাহান আলী, উপ-পরিদর্শক (এসআই) কাজী সুলতান আহমেদ ও অসিত কুমার রায়।
এরপর ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট ছেলে হারানোর শোকে মারা যান মামলার বাদী রঙ্গু মিয়া। বর্তমানে রঙ্গু মিয়ার ছেলে হুমায়ুন কবির পারভেজের ছোট ভাই মো. গোলাম ফারুক মামলাটির বাদী।
ঘটনার সময় সাইফুল ও হুমায়ূনের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে থাকা জসিম উদ্দিন বলেন, আমাদের তিনজনকে আটকের পর চোখ বেঁধে ফেলা হয়। ওইদিন মধ্যরাতে চোখ খোলার পর দেখি, আমি লাকসাম থানায়। তখন সেখানে হিরু ও হুমায়ুন ভাইকে দেখতে পাইনি। আমাকে র্যাব থানায় দিয়ে গেছে। তার মানে র্যাবই তাদের গুম করেছে। এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
নিখোঁজ হুমায়ুন কবির পারভেজের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার বলেন, পারভেজ এবং সাইফুল ইসলাম হিরু ভাইকে র্যাবই গুম করেছে। আমরা আজও জানি না, তাদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছে। আমরা জানতে চাই, তারা কি জীবিত, না কি তাদের মেরে ফেলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, হিরু-হুমায়ূনকে গুম করার উদ্দেশ্য হলো রাজনীতি। তাদের সরিয়ে প্রতিপক্ষ দলের স্থানীয় শীর্ষ নেতা লাভবান হয়েছিলেন।
নিখোঁজ সাইফুল ইসলামের একমাত্র ছেলে রাফসাল ইসলাম বলেন, অপহরণ ও গুমের একজন প্রত্যক্ষদর্শী তো আছেই। র্যাব তাকে থানায় পাঠিয়ে বাকি দুজনকে গুম করেছে বিষয়টি পরিষ্কার। তারেক সাঈদ এই গুমের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলে আমরা বিশ্বাস করি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব বেরিয়ে আসবে।
বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির পারভেজের ছোট ভাই গোলাম ফারুক বলেন, ৫ আগস্টের পর অনেকেই আয়নাঘর থেকে ফিরে এসেছেন। এ খবর পেয়ে আমরা ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছি। কিন্তু এখনো কোনো হদিস মেলেনি হিরু ও হুমায়ুন ভাইয়ের।
বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী মুহাম্মদ বদিউল আলম সুজন জানান, অপহরণ ও গুমের অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৮ মে র্যাবের পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কুমিল্লার আদালতে মামলা করেন হুমায়ুন কবিরের বাবা রঙ্গু মিয়া। পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও তাতে নারাজি দেন বাদী। কয়েক দফা তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একবারও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। এছাড়া এখন পর্যন্ত যারা মামলাটির তদন্ত করেছেন, তাদের কেউই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেননি। আগে যারা মামলার তদন্ত করেছেন, তাদের কেউ চাননি মামলাটি আলোর মুখ দেখুক। এজন্য তারা তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ করেছেন।
মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা কুমিল্লার সহকারী পুলিশ সুপার (লাকসাম সার্কেল) সৌমেন মজুমদার বলেন, সরকারের তিনটি তদন্ত সংস্থা কাজ করছে। আমরাও তদন্ত অব্যাহত রেখেছি। মনগড়া কোনো প্রতিবেদন জমা দিতে চাই না। বাদীপক্ষের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকেও বিস্তারিত জানা হবে এবং শিগগির অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি চেয়ে চিঠি দেওয়া হবে বলে পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান।
জাহিদ পাটোয়ারী/জেডএইচ/জেআইএম